বাগেশ্বর ধামের মহন্ত হিসাবে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীকে কদিন ধরে খুব হইচই হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে সমাজে কুসংস্কার ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী সেসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন “এসবই হল আমার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ।” তারপর ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী দাবি করেছেন, “তার পুনর্ধর্মান্তরকরণ প্রোগ্রাম দেখে আব্রাহামিকদের মধ্যে আতঙ্ক প্রবেশ করেছে এবং তারাই ভয় পেয়ে লোক লাগিয়ে আমার পেছনে লেগেছে।”
এরপর ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী বলেন, “খেয়াল করবেন কারা আমার কাছে প্রমাণ চাইছে? তারাই সে লোকজন, যারা কয়েক বছর আগেও ভগবান রামচন্দ্রের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করত। খেয়াল করবেন তারা নিয়মিত সনাতনীদের ধর্মবিশ্বাস, আস্থা নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন করে চলেছে; প্রমাণ চাইছে। কিন্তু ভুলেও আব্রাহামিক ধর্ম নিয়ে এরকম কিছু করার সাহস বা ইচ্ছা – কোনওটাই নেই। এদের গতিবিধি খেয়াল করলেই বুঝবেন, যেদিন থেকে আমি পুনর্ধর্মান্তরকরণ প্রোগ্রাম শুরু করেছি, আব্রাহামিকদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে এনেছি; সেদিন থেকেই এরা আমাকে নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেছে। তার আগে নয়। আমি যে ‘ছাতারি কথা’ শুরু করেছি, সেটাই ওদের কাছে আতঙ্কের বিষয়। এই কারণেই তারা আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। মনে রাখবেন, আমার বয়স অল্প এবং অবশ্যই এসবে ভয় পাওয়ার বান্দা আমি না। তারা যত পারে ষড়যন্ত্র করে যাক। তাদের যদি ক্ষমতা থাকে আমার সামনে আসুক। দেখবেন, কয়েক মিনিট থাকলেই প্যান্টেই পেচ্ছাব করে ফেলবে!”
ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী এতেই না থেমে দাবি করেন, “শুনুন, হিন্দুরা এখন জেগে উঠছে। তারা আর নিপীড়িত হয়ে থাকতে চাইছে না।” ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী বলে চলেন, “হিন্দু ধর্মের বিরোধীরা যেদিন থেকে আমাদের পেছনে লেগেছে, সেদিন আমি ওদের কৌশল বুঝে আর কথা বাড়াচ্ছি না। আমি কাজ দিয়েই সব প্রমাণ করব। তাদের যদি আমার কাজকর্ম নিয়ে আপত্তি থাকে, তবে মিডিয়ার সামনে ঘেউঘেউ না করে বাগেশ্বর ধামে আসুক, দরবারে বসে আমার কাজকর্ম দেখুক। বুঝে যাবে, আমার সম্পর্কে যা যা দাবি করেছে সব ভুল।”
এখানে বলে রাখি, ৫ থেকে ১১ জানুয়ারি ২০২৩ অবধি মহন্ত ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী নাগপুরে রামকথা প্রবচন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। ১৩ জানুয়ারি অবধি অনুষ্ঠান চলার কথা থাকলেও দুদিন আগেই তাকে অনিবার্য কারণ বশত ফিরে আসতে হয়।
রামকথা প্রবচন চলাকালীন মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতির জাতীয় প্রবক্তা শ্যাম মানব দাবি করেন ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী অনৈতিক পন্থায় কাজ করছেন, সমাজে কুসংস্কার ছড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীকে ৩০ লাখ টাকার চ্যালেঞ্জও জানান।
ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী পাত্তা না দেওয়ায় শ্যাম মানব ক্রুদ্ধ হন এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী অভিযোগের জবাবে বলেন, “আমি নাগপুরে ৭ দিন ছিলাম। তখন শ্যাম মানব না কি একটা, সে আমার দরবারে এসে চ্যালেঞ্জ করল না কেন? অন্তত পক্ষে একটা চিঠিও ত পাঠাতে পারত!”
ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী আরও বলেন, “শ্যাম মানবের ক্ষমতা থাকলে রায়পুরে আসুক। চ্যালেঞ্জ করুক। খালি হাতে ফিরবে না, গ্যারান্টি দিচ্ছি। কিন্ত জানি সেটা করার মুরোদ ওর নেই। দূর থেকে ঘেউ ঘেউই করে যাবে। আমি নীতেন্দ্র চৌবে বা কেশব মেহতাকে বলে রেখেছি যে, শ্যাম মানব কোনও চিঠি পাঠালে বা দেখা করতে এলে যেন আমাকে বলে। ও যেখানে খুশি চ্যালেঞ্জ জানাক।”
এরপর ব্যঙ্গের সুরে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী বলেন, “যখন মিশনারিরা পাইকারি হারে ধর্মান্তরকরণ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন এই শ্যাম মানবদের টিকিটাও পাওয়া যায় না, চ্যালেঞ্জ জানাবার সাহসটুকু অবধি হয় না। কি ভাবছেন, আমি এদের চালাকি বা উদ্দেশ্য বুঝি না? এরা আসলে মিশনারিদের দালাল ছাড়া আর কিছুই নয়।”
সুদর্শন টিভি জানিয়েছে ২৫ জানুয়ারি ২০২২ সালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী ৩০০ জন উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পুনর্ধর্মান্তরকরণ করেছে, যারা কোনও কারণে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছে। ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীই প্রথম ধর্মগুরু, যিনি এই কাজ করলেন। এতদিন কেবল নিম্নবর্ণের এবং আদিবাসীদেরই পুনর্ধর্মান্তরকরণ করা হচ্ছিল।

এদেশে দরগায় চাদর চড়ানো মনে হয় ধর্মনিরপেক্ষতার নজির। কিন্তু ভগবান হনুমানের উপাসনা করাটাও অপরাধ হয়ে যাচ্ছে।
যদি ভেবে থাকেন, ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী এখানে থেমে গেছেন, ভুল ভাবছেন। ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী আমাকে সাক্ষাৎকার দেবার সময়ে সাফ সাফ বললেন, “দেখুন মিস রাহানে, আমি অদ্যাবধি এমন কিছু করি নি, যাতে ব্যক্তিবিশেষ কারুর ক্ষতি হয় বা সম্প্রদায়ের অপমান হয়। হিন্দু ধর্মের স্বার্থ ছাড়া আমি কিছু দেখি না। তার জন্য মরতেও আমার আপত্তি নেই। আর হ্যাঁ, শ্যাম মানবকে এটাও বলে দেবেন, দম থাকলে শুধু আমাকে নয়, সাথে যত হনুমান উপাসক আছেন, তার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করে দেখান।”
এবার উত্তেজিত হয়ে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী বলেন, “এদেশে দরগায় চাদর চড়ানো মনে হয় ধর্মনিরপেক্ষতার নজির। কিন্তু হনুমানের উপাসনা করাটাও অপরাধ হয়ে যাচ্ছে। কুসংস্কারের নামান্তর হয়ে যাচ্ছে। শ্যাম মানবের মত লোকজন গির্জায় মোমবাতি জ্বালিয়ে যাওয়াটা বোধহয় বৈজ্ঞানিক কিছু মনে করেন তাই না? কিন্তু ইনি দেখি সর্বদাই অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলনের নামে শুধুই কালাভা, হনুমান চালিসা পাঠ বা পুনর্ধর্মান্তরকরণের মত অনুষ্ঠানকে কুসংস্কার, অন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধ কাজ মনে করেন। বলি, এত ঘৃণা পুষে রাখেন কিভাবে? এরকম দ্বিচারিতা নিয়ে ওর দলের লোকেরা প্রশ্ন তোলে না কেন?”
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বাগেশ্বর ধাম মধ্য প্রদেশের ছত্রপুর জেলায় অবস্থিত। এই মন্দির বহুকাল ধরে হনুমানের উপাসনা করে থাকেন। ২৬ বছর বয়সী ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীর আসল নাম ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ গর্গ। তিনি কয়েক বছর ধরে বাগেশ্বর ধামের মহন্ত পদে আছেন। সাধারণ মানুষ আদর করে তাকে ‘বাগেশ্বর ধাম সরকার’ বলে ডাকেন।
বাগেশ্বর ধামের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। তা থেকে জানা যাচ্ছে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীর ঠাকুরদা দাদা গুরুজি মহারাজ স্বহস্তে মন্দির স্থাপন করেছিলেন। তাকে সবাই ‘বাকসিদ্ধ’ মনে করতেন। তিনিই মারা যাবার সময়ে নিজ পৌত্রকে উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করেছেন। বেশ কয়েক বছর ধরে নিজস্ব ক্যারিশমা দেখিয়ে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন অনলাইন ও অফলাইন দুই মাধ্যমেই। বাগেশ্বর ধামে প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার একটা ‘দরবার’ও বসে, যেখানে বসে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী তার প্রবচনের পাশাপাশি নানান রকম অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেন এই ভাবেই তিনি পুনর্ধর্মান্তরকরণের কাজও করেছেন। ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী বরাবরই দাবি করে এসেছেন, তিনি যা যা করেছেন, সবই হনুমান বাবার কৃপা। তার কৃপা ব্যতীত তার পক্ষে এই জায়গায় পৌছনো সম্ভব হত না। এটাও তিনি দাবি করেন যে, তিনি কোনও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নন। তিনি শুধুই একজন মাধ্যম, হনুমানজি তার মাধ্যমে সব অলৌকিক কাণ্ড ঘটাচ্ছেন।
কয়েকদিন পূর্বে বাগেশ্বর ধামের নিজস্ব ইনস্টাগ্রাম পেজে একটি ভিডিওয় দেখা যাচ্ছিল ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী দাবি করেছেন তিনি যেদিন থেকে পুনর্ধর্মান্তরকরণ (হিন্দি ভাষায় ঘর ওয়াপ্সি) শুরু করেছেন, সেদিন থেকেই তিনি হিন্দু বিরোধীদের নিশানায় এসেছেন। সেখানেই তিনি শ্যাম মানবকে বিদ্রুপ করে প্রশ্ন করেন, “আপনার ক্ষমতা আছে অন্যান্য ধর্মের মধ্যে যেসব কুসংস্কার প্রচলন আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করার? নাকি আপনি হিন্দু বিরোধী শক্তিদের দালাল?”
তারপর ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী বলেন, “আমি দেখছি আপনার খুব সমস্যা হচ্ছে পুনর্ধর্মান্তরকরণ নিয়ে। অথচ আপনাকে কোনওদিন দেখিনি এক বস্তা চালের বিনিময়ে গরিব হিন্দুদের যখন খ্রিস্টান বানানো হয়। কেন? নাকি অন্য ধর্মে কুসংস্কার আপনার চোখে কুসংস্কার নয়?” একটু থেমে ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী আবার বলেন, “আমি প্রত্যেক হিন্দু ভাইবোনকে অনুরোধ করছি এই ধরণের ধান্দাবাজ, দ্বিচারিতার প্রতিমূর্তিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, একজোট হতে। এখনই একজোট না হতে পারলে আর কোনওদিনও হতে পারবে না। শুধু একজোট হওয়াই নয়, অন্য ধর্মের মধ্যে যেসব অন্যায় নিয়ম, কুসংস্কার আছে, তার বিরুদ্ধে মুখ খোলো, শ্যাম মানবকে চাপ দাও যাতে সে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়। সেটা ওরা করবে না, যদি না আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।”
এরপর ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রী যেটা বলেন, তা নিয়ে প্রচুর হইচই পড়েছে। তিনি বলেন, “হিন্দু ভাইবোনদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, তারা যেন কোনও অবস্থাতেই দরগ়ায় বা চার্চে না যান। তারা দরকারে যেন গুরুদ্বার, বৌদ্ধ বা জৈন মন্দিরে যান। কিন্তু বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ধর্মস্থান এড়িয়ে চলুন।”
ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীর সমর্থনে অনেক হিন্দু সংগঠন এগিয়ে এসেছে। উদাহরণ হিসাবে মধ্য প্রদেশ সন্ত পূজারী সঙ্ঘ, সংস্কৃতি বাঁচাও মঞ্চের নাম করা যায়। তারা ২১ জানুয়ারি একটি প্রস্তাব পেশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে — “যারা ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে শুধু মামলা করা হবে তা নয়, সাথে জোরদার আন্দোলনও চালানো হবে; যাতে ভবিষ্যতে হিন্দু সন্তদের বিরুদ্ধে কেউ শ্যাম মানবের মত দুঃসাহস না দেখায়।”
এদিকে আজতক জানিয়েছে তারা সংবাদ পেয়েছে যে, মধ্যপ্রদেশের ছত্রপুর জেলার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীর জ্যাঠতুতো দাদা লোকেশ গর্গ একটি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির তরফ থেকে হুমকি পেয়েছেন – ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীকে হত্যা করা হবে।
রাত ৯.১৫ নাগাদ জনৈক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি প্রথমে তাকে বলে, “ধীরেন্দ্র কী এখানে আছে? ওর সাথে কথা বলতাম।”
তখন লোকেশ জিজ্ঞাসা করেন, “কোন ধীরেন্দ্র?” উত্তরে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি বলে ওঠে, “ওকে হত্যা করা হবে। ওকে সাবধানে থাকতে বলিস।” এরপরেই ফোন কেটে দেওয়া হয়। পুলিস এরপর সক্রিয় হয় এবং বাগেশ্বর ধামকে পাহারা দেয়া শুরু করে।
ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ শাস্ত্রীর সমর্থনে কৈলাস বিজয়বর্গিয়, কপিল মিশ্র, মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্রের মত বিজেপি নেতারা শুধু নন; এমনকি কংগ্রেসের নেতারাও এগিয়ে এসেছেন। ছত্তিসগড়ের বিধায়ক বিকাশ উপাধ্যায়ের কথা বলা যায়। তিনি পুনর্ধর্মান্তরকরণের পক্ষে কথা বলে দাবি করেছেন মিশনারিদের দালালরাই ওর বিরুদ্ধে লেগেছে। তাকে ওয়াই ক্যাটেগরি সুরক্ষা দেওয়া উচিত। অনেকটা একই দাবি করেছেন ছত্তিসগড়ের কংগ্রেস সাংসদ অমিত শ্রীবাস্তব।
লেখা: শ্রদ্ধা রাহানে। (OpIndia)
অনুবাদ: অয়ন চক্রবর্তী।