বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের গত দুইশো বছরে এত তথাকথিত অবতারের জন্ম হয়েছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান হয়ত কেউ দিতে পারবে না। গত পঞ্চাশ বছরে বঙ্গে যত মন্দির হয়েছে, এর অধিকাংশই বিভিন্ন গুরুদেবদের মন্দির। এ গুরুদের অন্ধ শিষ্যরা সকলেই তাদের গুরুকে ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় বুয়েটের এম এ রশীদ হলে আমার এক নেপালি বন্ধু ছিল। নাম ছিল উমেশ গৌতম। অসম্ভব অমায়িক স্বভাবের ছিল সে। উমেশ নিয়মিত আমাদের জগন্নাথ হলে আসত। আমিও যেতাম এম এ রশীদ হলে। লালবাগের ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং রমনা কালী মন্দিরে বেশ কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে। তাই ঢাকা শহরের অন্যান্য মন্দিরগুলো দর্শন করানোর জন্যে উমেশ আমাকে অনুরোধ করে। তাকে পুরাণ ঢাকার মন্দিরগুলো ঘুরে দেখাতে আমিও রাজি হয়ে যাই। সে অনুসারে ২০০৬ সালের শুরুর দিকে একটি শুক্রবারের ছুটির দিনে, উমেশকে নিয়ে আমি পুরাণ ঢাকার মন্দিরগুলো ঘুরিয়ে দেখানো শুরু করি। আমি ভাবলাম, পুরাণ ঢাকার মন্দিরগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার, সূত্রাপুর, সদরঘাট ; অন্য দ্বিতীয় ভাগে স্বামীবাগ, টিকাটুলি, গোপীবাগ ইত্যাদি। তখন আমি ভাবি, এই সপ্তাহ উমেশকে স্বামীবাগ, টিকাটুলি রামকৃষ্ণ মিশনের দিকে নিয়ে যাই, অন্য সপ্তাহ ওকে অন্যস্থানে নিয়ে যাব। এই মনে করে এক শুক্রবার বন্ধের দিন আমরা দুজনে রিক্সায় করে মন্দির দর্শন শুরু করি।
প্রথমেই যাই স্বামীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমে। উমেশ খুবই খুশী হয় আশ্রমটি দেখে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম থেকে এরপরে আমরা যাই, টিকাটুলি পুলিশ বক্সের পাশে জগদ্বন্ধু সুন্দরের মহাপ্রকাশ মঠে। সদ্য তরুণ বয়সের জগদ্বন্ধু সুন্দরের চিত্রকে অবলম্বন করে তৈরি অপূর্ব সুন্দর মূর্তিটি আকর্ষিত করে ভক্তদের। স্বর্গীয় অপূর্ব চাহনিযুক্ত বিগ্রহটির দিকে তাকালে মনে হয় জগদ্বন্ধু সুন্দর বুঝি জীবন্ত বসে আছেন। এরপরে আমরা যাই কে এম দাশ লেনে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজের বিপরীতে ভোলানন্দ গিরি আশ্রমে। আশ্রম মন্দিরের উত্তরদিকের বেদিতে পূজিত হচ্ছে, স্বামী ভোলানন্দ গিরি মহারাজের একটি মূর্তি। মন্দিরের একই কক্ষে পশ্চিম দিকের বেদিতে পূজিত হচ্ছে স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের একটি বড় তৈলচিত্র। চাইলে স্বামী ভোলানন্দ গিরি মহারাজ এবং স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজ এ দুজন শৈব সন্ন্যাসীকে একসাথে একই বেদিতে রেখেই তাঁদের পূজা করা যেত। কিন্তু সবার কাছে তাদের গুরুই ভগবান, তাই কি আর করা। একই মন্দিরে দুইপাশে দুজন মহাপুরুষের দুটি পূজার আসন। সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই বিভ্রান্ত হয়ে যায় যে, উত্তরদিকে নাকি পশ্চিমদিকে কোনদিকে ফিরে সে প্রণাম করবে।
ভোলানন্দ গিরি আশ্রম থেকে পরবর্তীতে আমরা যাই, অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীতে ২০০৫ সালে সদ্য নির্মিত গোপীবাগে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে। মন্দিরের চূড়ায় নটরাজের মূর্তি এবং মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন গ্রহদেবতাদের মূর্তি দেখে আমিও মুগ্ধ হই। বন্ধু উমেশও প্রচণ্ড মুগ্ধ হয়। রামকৃষ্ণ মন্দিরের বাইরের অংশটি দেখে, আমরা মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করি।মন্দিরে প্রবেশ করে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে প্রণাম করে চরণামৃত গ্রহণ করি। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বিগ্রহের কক্ষটি কাঁচ দিয়ে ঘেরা। এ কাঁচের ঘেরাও পর্যন্ত চলে গিয়ে, কাঁচে হাত দিয়ে প্রচণ্ড কৌতুহলী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে আমার বন্ধুটি। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, কি হয়েছে? উমেশ একরাশ কৌতুহল নিয়ে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে, মন্দিরে ভগবান কোথায়? পদ্মের বেদিতে বসা রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিগ্রহ দেখিয়ে আমি বলি, ঐযে বসা আছে। উমেশ বলে, এটা তো মানুষের মূর্তি! তোমাদের বাংলাদেশে কি শুধু মানুষের মূর্তিই পূজা হয়?
সাথে সাথে আমার স্মরণ হয়, তাই তো আমি আজ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দির থেকে রামকৃষ্ণ মন্দির পর্যন্ত যত মন্দির বন্ধু উমেশকে দেখিয়েছি, সকল মন্দিরেই পূজার বেদিতে মানুষের বিগ্রহ। যার যার গুরুদেবের ছবি বা মূর্তি পূজিত। তবে কয়েকটি মন্দিরে প্রধান বিগ্রহের সামনে বা পাশে বাণলিঙ্গ, নারায়ণ শিলা, গণেশের প্রতিমা ইত্যাদি বিগ্রহাদি পূজিত। অর্থাৎ বন্ধুকে আমার দেখানো মন্দিরগুলোতে শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, কালী, কৃষ্ণ আমাদের পূজিত প্রাচীন দেববিগ্রহ পার্শবিগ্রহ হিসেবে থাকলেও, কোথাও মূলবেদিতে পূজিত নয়। শুধু জগদ্বন্ধু মঠে, জগদ্বন্ধু সুন্দরের সাথে একই বেদিতে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ পূজিত। আমি বন্ধুর প্রশ্নের কি উত্তর দিব, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। একটু সামলে নিয়ে ওকে পাল্টা প্রশ্ন করি, তোমাদের নেপালের মন্দিরগুলোতে কি আমাদের মত এরকম মানুষের বিগ্রহাদি পূজিত হয় না? উত্তরে উমেশ বলে- দেখ বন্ধু, নেপালে যে অঞ্চলে আমাদের বাড়ি, সেখানে জন্ম থেকে কোনদিনও আমরা মন্দিরে কোন মানুষের পূজা হতে দেখিনি। একবার কিছু ভারতীয় মাড়োয়ারিরা মিলে সাঁইবাবার একটি মন্দির তৈরি করে পূজা শুরু করে। কিন্তু অনেক দিন চলে যাবার পরেও, মন্দিরে কোন নেপালিই পূজা দিতে যেত না। বিষয়টি যখন সাঁই বাবার মন্দির কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, তারা তখন নিজেদের শুধরে নিয়ে পূজার মূলবেদিতে শিববিগ্রহ স্থাপন করে এবং সেই শিববিগ্রহের পায়ের কাছে সাঁইবাবার মূর্তিটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে সাধারণ নেপালি হিন্দুরা সে মন্দিরে ধীরেধীরে যাওয়া শুরু করে।
উমেশের কথাগুলো শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই। আমি ভাবি, আহারে আমাদের বঙ্গেও যদি এমন হত কতই না ভাল হত। নেপালিদের সাথে মিশে মনে হয়েছে, তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের থেকে অনুভূতি এবং বিশ্বাসটা তীব্র। সাধারণ নেপালি মানুষেরা অত বেশি ধর্মীয় জ্ঞানে ডুব না দিয়েও, অন্ততপক্ষে এই সহজ সরল সত্যটা সকলেই জানে যে, মন্দিরে দেববিগ্রহ পূজিত হয়। মানুষের মূর্তি নয়। যিনি মহাপুরুষ, সাধক পুরুষ ; তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা করব। কিন্তু সেই শ্রদ্ধা যেন শ্রদ্ধার সীমানা অতিক্রম করে না যায়। আমরা তেলবাজি করে, বর্তমানে আমাদের আশেপাশের সকল মহাপুরুষ সাধকপুরুষদেরই অবতার বানিয়ে পূজার বেদিতে বসিয়ে দিতেছি। মহাপুরুষ সাধকপুরুষদের কালী-কৃষ্ণ-শিব ইষ্টদেবতাকে বাদ দিয়ে, আমরা সাধকপুরুষদেরই আমাদের ইষ্টদেবতা বানিয়ে ফেলেছি। মহাপুরুষেরা আমাদের জীবনে সদা অনুসরণীয় ; কিন্তু তাঁরা আমাদের আরাধ্য ইষ্টদেবতা নয়। মানুষকে ভগবান সাজিয়ে পূজা করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। এ প্রসঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশনা আমাদের সকলের স্মর্তব্য এবং অনুসরণীয়। মানুষকে অতিস্তুতি করে যে ঈশ্বরের অবতার বানিয়ে ফেলা হয়; এ বিষয়টির ঘোরতর বিরোধী ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব । বাংলার আনাচে-কানাচে গত দেড়শো বছরে অবতারের হাইব্রীড ফসল দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে।কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে বলেছেন,”জীবধামে কৃষ্ণজ্ঞান” না করতে। জীব এবং ঈশ্বর সমান নয়। যে মূর্খ জীবকে ঈশ্বরের সমতুল্য মনে করে, তাকে পাষণ্ডী বলে। যমরাজও সেই পাষণ্ডীকে দণ্ড প্রদান করে।
প্রভু কহে বিষ্ণু বিষ্ণু ইহা না কহিহ।
জীবধামে কৃষ্ণজ্ঞান কভু না করিহ।।
জীব ঈশ্বর তত্ত্ব কভু নহে সম।
জলদগ্নি রাশি যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ।।
যেই মূঢ় কহে জীব ঈশ্বর হয় সম।
সেই ত পাষণ্ডী হয় দণ্ডে তবে যম।।
(চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্য, অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ)
শ্রীচৈতন্যদেব সহ সকল মহাপুরুষের আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে আমরা একটি সময়ে হয়ত একদিন জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে পারব। সে দিন বেশী দূরে নয়, এ মানুষের মন্দিরগুলো একদিন পূর্বের মত সেই দেব মন্দির হবে। মাত্র অর্ধশতাব্দী পূর্বেও অধিকাংশ মন্দিরে দেববিগ্রহ পূজিত হত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মন্দিরে পূজিত হয় বিভিন্ন গুরু, তার অনুসারী এবং তাদের সন্তানসন্ততি। যে মহাপুরুষ কালীর উপাসক, সেই মহাপুরুষের অনুসারীদের তৈরি মন্দিরে দেবী কালীর বিগ্রহ মূলবেদিতে থাকা উচিত। এবং দেবী কালিকার বিগ্রহের পায়ের কাছে, সেই সাধক বা মহাপুরুষের ছবি বা মূর্তি থাকতে পারে। একইভাবে যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসক বা ভগবান শিবের উপাসক তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকটি মন্দিরের মূলবেদিতে দুর্গা, কালী, শিব, বিষ্ণু, কৃষ্ণ প্রমুখ দেববিগ্রহ পূজিত হবে।এ উপাস্য বিগ্রহাদির পায়ের কাছে থাকবে বিভিন্ন সাধক এবং মহাপুরুষদের ছবি অথবা বিগ্রহ। কিন্তু নির্মম পরিহাস হল, অধিকাংশক্ষেত্রেই সাধকের ছবি বা মূর্তি পূজিত হলেও, সেই সাধকের আরাধ্য কৃষ্ণ, কালী বা শিব ইত্যাদি বিগ্রহাদি গুরুবাদী আশ্রমগুলোতে মূলবেদিতে পূজিত হতে দেখা যায় না।
লেখা: শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।