Home - ইতিহাস - শ্রীকৃষ্ণাষ্টকস্তোত্রের ইতিহাস ও মাহাত্ম্য জানেন কী?
ভূমিকা:
শ্রীশঙ্করাচার্য অদ্বৈত বেদান্তদর্শনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার। তাঁর জন্ম ৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দের (মতান্তরে ৭৮৮ খ্রি.) ১২ বৈশাখ শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে কেরালা প্রদেশের ‘কালাডি’ নামক একটি ছোট্ট গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন শিবগুরু এবং মাতা বিশিষ্টা দেবী। শ্রীশঙ্করাচার্য সনাতন ধর্মের সকল মতপথের সমন্বয়ের প্রতীক।তিনি উপাধিভেদে সাকার নিরাকার সকল মতপথের প্রচারক ছিলেন। তাঁর রচনায় আমরা চিন্তার অতীত ব্রহ্মকে নিয়ে অনেক স্তোত্র পাই, তেমনি ঈশ্বরের স্বগুণরূপি বিভিন্ন দেবতা এবং অবতারেরও স্তোত্রপাই। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ঈশ্বরকে যেভাবেই আমরা উপাসনা করিনা কেন তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।
কৃষ্ণাষ্টক স্তোত্রে তিনি একই সাথে চিন্তার অতীত ব্রহ্ম, তাঁর পালন রূপ বিষ্ণু এবং সে বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণকে একই সাথে বন্দনা করেছেন। নিরাকার বাতাস যেমন চোখে দেখা যায় না, উপলব্ধি করা যায়; ঠিক একইভাবে চিন্তার অতীত ব্রহ্মই যখন অবতার রূপে আসেন তখন তাকে আমরা দেখতে পারি, ছুঁতে পারি এবং সেই দৃষ্টিগোচর রূপকে অনুসরণ করে সাধনজগতে অগ্রসর হতে পারি। তিনি সর্বভূতে বিরাজমান। এটা এমন নয় যে, তিনি পাঁচতলা, সাততলা, দশতলা আকাশের উপরে বসে আছেন। অথবা তিনি যখন আসেন, তখন তাঁর বসবাসের স্বর্গলোক খালি পরে থাকে। বা তিনি চেয়ারের বসে আমাদের শাসন করেন, কিন্তু তিনি যখন অবতার রূপে জগতে আসেন তখন তাঁর চেয়ারটি শূণ্য পরে থাকে। বিষয়গুলি এমন না, একেবারেই আলাদা। এ দৈব জগতের দৈবীভাষা অনেকেই বুঝতে পারেন না। তাঁর কৃপায় হয়ত কিছু ঋষি মুনিরা তাঁকে জানতে পেরেছেন, কিন্তু তিনি সকল জ্ঞানের পারে, নিরবচ্ছিন্ন সাধন এবং জন্মজন্মান্তরের সুকৃতির ফলে কোন কোন অধিকারী হয়ত তাকে সামান্যতম জানতে পারে, এর বেশী নয়। সম্পূর্ণ তাকে জানা অসাধ্য। তিনি একজনই এ বিষয়টি বেদে তো আছেই, শ্রীশঙ্করাচার্যও অদ্বৈত বেদান্তের প্রচারক হলেও আমাদের অত্যন্ত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন রচনায়। একই সত্ত্বার শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন হওয়ার কারণে এ দৃশ্যমান বিভিন্ন স্বরূপ দেখে মায়ার প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাই আমরা প্রতিনিয়ত। উপাস্য রুচির বৈচিত্রের জন্যে একই ব্রহ্মের আলাদা আলাদা রূপের প্রকাশ। আমরা এক পরমেশ্বর ছাড়া দ্বিতীয় কারো উপাসনা করি না। বেদে বিভিন্ন মন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর এবং স্পষ্ট করে বিষয়টা বলা হয়েছে :
“সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।”
“পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলে অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলে জানেন একমাত্র তিনিই তাঁকে প্রাপ্ত হন।”
সাকার নিরাকার বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় স্বরূপে তিনি যে একজনই এ বিষয়টি তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের একটি শ্রুতিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে।
” জীবের হৃদয়ে পরমাত্মা অবস্থিত। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শিব, তিনিই হরি, তিনিই ইন্দ্র। তিনি অক্ষর, স্বয়মদীপ্ত রাজা, তিনিই জীবের শ্রেষ্ঠ গতি।”
বিভিন্ন রূপরূপান্তর ভেদে আমরা যে একই ব্রহ্মের উপাসনা করি, শাস্ত্রীয় এ বিষয়টি অনেকে বুঝতে পারিনা বলেই আমরা সাম্প্রদায়িক শাস্ত্রীয় বিবাদে জড়িয়ে যাই। যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
” শক্তি স্বরূপা শ্রীকে আলিঙ্গিত করে অভেদমূর্তিতে আছেন যে বিষ্ণু, যিনি চরাচর সকলের গুরু, বেদের যিনিই একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয়, যিনি বুদ্ধির সাক্ষীরূপ সর্বান্তর্যামী, যিনি অসুর বিনাশক, পদ্মকমলের ন্যার রক্তিম যাঁর নয়ন। যিনি শঙ্খ, চক্র ও গদা ও বিমল বনমালা ধারণকারী। যাঁর দেহের উজ্জল দীপ্তি সর্বদা বিরাজমান। যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ। চিন্তার অতীত ব্রহ্মই যখন ক্রিয়াশীল হয়ে জগতের কার্য করে করেন তখনই তাকে শক্তি বলে। আদিপুরুষ শ্রীবিষ্ণুর শক্তির নাম শ্রী বা লক্ষ্মী। বিষ্ণু এবং তৎশক্তি শ্রী অভেদ। যেমন, চন্দ্র এবং চন্দ্রের কিরণ, দুধ এবং দুধের ধবলতা অভেদ। স্তোত্রটির শুরুতেই শঙ্করাচার্য তাই আপাত দুইদেহ মনে হলেও লক্ষ্মীনারায়ণের আলিঙ্গিত অভেদমূর্তিকে বন্দনা করেছেন।
বেদাদি শাস্ত্রে বহুস্থানেই ভগবানকে গুরু বা জগদগুরু বলা হয়েছে, কারণ সকল জ্ঞানের উৎস তিনি। জীবকে সৃষ্টি করেছেন তিনি, সকল জ্ঞানের উৎসও তিনি, তাই তাকে জগদগুরু বলা হয়। শ্রীমদ্ভাগবত সহ বিভিন্ন পুরাণ এবং যোগদর্শনে ভগবানকে গুরু বলে অবিহিত হতে আমরা দেখি।কিন্তু ইদানিং বিভিন্ন গুরুদের নামের সাথে শব্দটি দেখা যায়। যা ঠিক নয়। যেহেতু শাস্ত্রে ভগবানকে জগদগুরু বলে অবিহিত করা হয়েছে, তাই অন্যের ক্ষেত্রে শব্দটি প্রয়োগ করা সমীচীন নয়।
বেদের সকল জ্ঞানের প্রতিপাদ্য বিষয় ভগবান। ঋষিদের ধ্যানলব্ধ বেদই আমাদের ঈশ্বরকে এবং তাঁর পথকে জানিয়ে দেয়। কারণ, বেদের একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় ভগবান। বেদের জ্ঞান হল চারপ্রকার বাকের মধ্যে পশ্যন্তি বাক। এর উর্ধ্বে আরেকটি বাক আছে যাকে পরা বাক বলা হয়। এ পরা বাক ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, তাই এ বাক অবাঙ্মানসগোচর। সাধক ধ্যানের গভীরে শুধু এ বাকরূপ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে ভূমানন্দ লাভ করে।
“সৃষ্টিকালে আকাশ ও বায়ুমণ্ডল সহ সমগ্র জগৎ যার থেকেই উৎপন্ন হইয়াছে। স্থিতিকালে যিনি আনন্দময় অংশের দ্বারা অনন্তব্রহ্মাণ্ড পালন করেন। যিনি মধুদৈত্যকে বিনাশ করেছেন। প্রলয়কালে যিনি আপনাতে সকল বিলীন করেন।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
পরমেশ্বর এ জগতের দুটি কারণের কারণ। এক নিমিত্ত কারণ, দুই উপাদান কারণ। নিমিত্ত কারণ মানে, এ জগতের সুসংগঠিত সুসংবদ্ধতার পেছনে যে চেতন সত্ত্বা; সেই বুদ্ধিদীপ্ত চেতন সত্ত্বাই হল ঈশ্বরের শক্তি। উপাদান কারণটি হল, এ জগতের প্রত্যেকটি জড়, চেতন প্রত্যেকটি উপাদানেই তিনি। তিনি ছাড়া আর কিছুই নেই। অর্থাৎ একটা মাটির হাড়ি তৈরি করতে কুমারও তিনি; মাটি, জল, চাকাও তিনি ; আবার কুমারের মাটির হাড়ি তৈরির ইচ্ছাও তিনি। ঈশ্বরের মধ্যে এমন সৃষ্টির ইচ্ছা জাগে, তাকে সিসৃক্ষা বলে । বহু হওয়ার বাসনা থেকেই তিনি বহু হন। সৃষ্টিকালে আকাশ ও বায়ুমণ্ডল সহ সমগ্র জগৎ তাঁর থেকেই উৎপন্ন হয়। আবার প্রলয়কালে তাঁর শরীরেই সুপ্তাবস্থায় থাকে। স্থিতিকালে আনন্দময় অংশের দ্বারা তিনি অনন্তব্রহ্মাণ্ড পালন করেন, একে বলা হয় লীলা। তাঁর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই, তাই লীলাবিলাশে একটি বিরাট শিশু হয়ে আনমনে তিনি জগত নিয়ে খেলছেন।
আসুরিক শক্তি ভগবানের বাইরে নয়। তিনিই সকল শক্তির উৎস। তিনিই জীবকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছেন, এ স্বাধীনতা পেয়ে কোন জীব যদি আসুরিক ভাবাপন্ন হয়ে যায় তখন ভগবান লোকশিক্ষার জন্যে তাদের বধ করেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, মধু এবং কৈটভ নামক দৈত্য দুইভাইকে বধ করেন। তাই তাঁর নাম হয় মধুসূদন। ভগবানের কোন শত্রু মিত্র নেই। সকল জীবই তাঁর সৃষ্ট। তিনি দ্রষ্টাপুরুষ। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“সুন্দর পাখাবিশিষ্ট সমান সমন্ধযুক্ত দুটি পাখি মিত্ররূপে একটি গাছে আশ্রয় করে আছে। তাদের মধ্যে একটি পাখি বৃক্ষের বিভিন্ন স্বাদের ফল খেয়ে চলছে এবং অন্য পাখিটি শুধুমাত্র দেখছে।”
এই বৃক্ষটিতে অবস্থিত পাখিদুটির মত আমাদের একইদেহে জীবাত্মা এবং পরমাত্মা বিরাজিত। ইচ্ছার স্বাধীনতা পাওয়া জীবাত্মাটি কর্ম অনুসারে কর্মফল ভোগ করে সুধু। এ কর্মের সুকৃতির ফলে দেবতুল্য হয় এবং দুষ্কর্মের ফলে অসুর হয়। সুর এবং অসুর জীবের কর্মের মধ্যে, যে যে পথকে বেঁছে নেয়।
ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ভাল-মন্দ, পজিটিভ নেগেটিভ সকল শক্তির উৎসই তিনি। ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক গুণভেদেই শুভ অশুভের উৎপত্তি। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জাতিই বিশ্বাস করে ভালোর জগতের একজন ঈশ্বর; খারাপ জগতের আরেকজন ঈশ্বরের কনসেপ্ট। রেললাইনের মত সমান্তরালভাবে চলছে তাদের দুই ঈশ্বরের শুভ অশুভের রাজত্ব।
“শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগণ প্রাণসংযম করে, যমনিয়মাদি যোগের সাধন করে, ইন্দ্রিয়কে নিরোধ করে, চিত্ত বিলীন করে, নিজ হৃদয়ে লোকপূজ্য মায়াময় বিষ্ণুকে দর্শন করেন।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ। এ প্রসঙ্গে মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর ‘যোগসূত্র’ গ্রন্থে বলেছেন:
অষ্ট যোগের অঙ্গকে অবলম্বন করে পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়কে সংযত করে চিত্তকে বিলীন করতে পারলেই সাধক নিজ হৃদয়ে মায়াময় শ্রীবিষ্ণুকে দর্শন করে। ভগবান মায়া শক্তি দ্বারাই এ জগতকে পরিচালনা করেন। ঋগ্বেদেও ইন্দ্ররূপি পরমেশ্বরের মায়াশক্তির কথা বর্ণিত আছে। এ মায়াতেই জীব বদ্ধ হয়, আবার এ মায়াতেই জীব মুক্ত হয়।
“পৃথিবীতে থেকেও যিনি মহীমণ্ডল পরিচালনা করেন, কিন্তু পৃথিবী যাঁকে জানতে পারে না এ তত্ত্বটি “যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্ পৃথিবীং যমপতি যং পৃথিবী ন বেদ” ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যে (বৃহদারণ্যক) বর্ণিত।যিনি জগতের অধীশ্বর, সর্বপ্রকার দোষশূন্য অমল। যিনি সকলের একমাত্র নিয়ন্তা। সিদ্ধ মুনিগণ, দেবগণ ও রাজগণ যাকে নিয়ত ধ্যান করেন। যিনি সকলের মোক্ষদাতা।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
ভগবান জগতের প্রত্যেকটি অনু-পরমানুতে আছেন,জগতকে পরিচালনা করেন, আবার প্রয়োজন হলে লোককল্যাণে তাঁর মায়াশক্তির দ্বারা অবতীর্ণ হন ভুতলে। কিন্তু তিনি অচিন্তনীয়। আমরা যা চিন্তা করব, তাই মিথ্যা হয়ে যাবে। শুধু সাধকের হিতার্থে বিভিন্ন প্রতীকে বিভিন্ন মূর্তিতে আমরা তাঁর পথে অগ্রসর হই। এ ইন্দ্রিয়গুলিকে পরিচালিত করেন তিনি, কিন্তু এ ইন্দ্রিয়গুলো কখনই তাকে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারে না। ভগবান নিজের গীতাতে বলেছেন, তিনি তাঁর একাংশ দ্বারাই এ জগতকে ধারণ করে আছেন। অর্থাৎ তিনি সীমার থেকেও অসীম। হৃদয় যত নিষ্পাপ অপাপবিব্ধ হয়, ততই তিনি ধরা দেন। সিদ্ধ মুনিগণ, দেবগণ ও রাজগণ তাঁকে নিয়ত ধ্যান করেন, কারণ তিনিই সকলের মোক্ষদাতা পরমেশ্বর।
“মহেন্দ্রাদি দেবগণ যাঁর শক্তিতেই দানবদিগকে পরাজিত করেন, যাঁর শক্তির ব্যতিরেকে কারও কোন স্বাতন্ত্র্য নেই, যার শক্তিসাহায্য ভিন্ন জগতে কোন কার্য্যই স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হয় না, যিনি অহংকারী পণ্ডিতবর্গের কবিত্বাভিমান এবং গর্বিত দিগ্বিজয়কারীদের সকল গর্ব হরণ করেন।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
কেন উপনিষদে হৈমবতী উপাখ্যানে আছে, যে একবার অসুরবিজয়ে দেবতাদের অহংকার জন্মে। পরে ব্রহ্ম এক জ্যোতির্ময় মূর্তিতে উপস্থিত হয়ে মহেন্দ্রাদি দেবগণের দ্বৈতবোধকে অপনোদন করে অভেদ জ্ঞান দান করেন। দেবতাদের শক্তি আদতে ব্রহ্মেরই শক্তি। দেবতারা ব্রহ্মের শক্তির প্রকাশ মাত্র। আলাদা কিছুই নয়। এ কারণেই ঋগ্বেদে ইন্দ্র বলতে কোন সাধারণ দেবতা নয়, ইন্দ্ররূপী পরমেশ্বরই বর্ণনা করা হয়েছে।
আমরা পূর্বেই বলেছি প্রত্যেকটি জীবের ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে, আবার এ শ্লোকে বলা আছে,
“যাঁর শক্তির ব্যতিরেকে কারও কোন স্বাতন্ত্র্য নেই, যার শক্তিসাহায্য ভিন্ন জগতে কোন কার্য্যই স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হয় না।”- এ দুটি তত্ত্ব আপাত পরস্পরবিরোধী হয়। কিন্তু পরস্পরবিরোধী নয়। এর সমাধানে বলা যায়, প্রত্যেকটি জীবকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দেয়া আছে ঠিক, সে অনুযায়ী সে সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক কর্ম করে পাপপুণ্যের জালে জড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে ঈশ্বর হলেন দ্রষ্টাপুরুষ বা সাক্ষী। কিন্তু ইচ্ছার স্বাধীনতার ফলে যে উৎপন্ন কর্মফল, সে কর্মফল তাকে ভোগ করতেই হবে। এর হাত থেকে মুক্তি নেই। এ কর্মফলের দাতাই হলেন ভগবান। জীবের কর্মের উপরে হাত আছে, নিয়ন্ত্রণ আছে স্বাধীনতা আছে। কিন্তু কর্মফলের উপরে হাত নেই। তাই শ্রীশঙ্করাচার্য বলেছেন, একজন দুর্বিনীত অহংকারী পণ্ডিতের কবিত্বাভিমান অথবা একজন গর্বিত দিগ্বিজয়কারী রাজার সকল শক্তির উৎসই ভগবান। শক্তিতে গর্বিত মদমত্ত হলে নিমেষেই তা চলে যেতে পারে।
“যে পরমেশ্বরকে ধ্যান না করলে জীব শূকরাদি পশুত্বপ্রাপ্ত হয়, যাঁর জ্ঞান ব্যতিরেকে জীব জন্ম-মৃত্যুর ভয়ে বশীভূত হয়ে থাকে, যাঁকে স্মরণ না করিলে প্রাণিগণ শত শত কৃমিযোনি প্রাপ্ত হয়। যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
পরমেশ্বরের সাথে যুক্ত থাকাটাই মুখ্য। আমরা নামজপ, কীর্তন, পূজা, উপাসনা, শাস্ত্রচর্চা, ধ্যান বিভিন্নভাবে ভগবানের সাথে যুক্ত থাকতে পারি। তবে এরমধ্যে ধ্যান একটি উত্তম পন্থা। যেহেতু ঋষি মুনিরা সে পন্থা অবলম্বন করেই বেদের জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন। তাই ভগবান শ্রীহরিকে সর্বদা স্মরণ করতে হবে। ধ্যান, স্মরণ বা নামজপে হৃদয়ের মধ্যে একটি ধারণা জন্মাবে। এ ধারণা থেকেই উৎপন্ন হয় সমাধি। আর সমাধিতেই পাওয়া যায় আনন্দময় ভগবানকে, তখন আর জীবের মৃত্যুভয় থাকে না। এবং তখন জন্মজন্মান্তরের বন্ধনও কেটে যায়। জীবের চুরাশিলক্ষ জন্মের ফলে মনুষ্য জন্ম হয়। মনুষ্যজন্মে ঈশ্বর প্রাপ্তি সহজ। কিন্তু যদি সেই মনুষ্যজন্ম স্বার্থক করতে আমরা ঈশ্বরের পথে অগ্রসর না হই, তবে মনুষ্যজন্ম বৃথা হয়ে অন্ধকারের পথে অগ্রসর হয়।
“যিনি জীবের ভীতিহরণ করেন। যিনি শরণাগতদের একমাত্র আশ্রয়। যিনি জগতের সকল ভ্রান্তিহরণ করেন।যিনি ঘনশ্যাম অর্থাৎ মেঘতুল্য শ্যামবর্ণ যার গায়ের রং।যিনি রামরূপে অবতীর্ণ, যিনি ব্রজবালকদের বয়স্য, যিনি অর্জুনের সখা।যিনি স্বয়ম্ভু, জগতপিতা হয়েও নিজ ইচ্ছাবশে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি সুআচরণকারীদের যথোচিত সুখপ্রদানকারী।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
ভগবান তাঁর শরণাগত ভক্তের সকল ভীতি হরণ করেন। আমরা ভক্ত প্রহ্লাদের জীবনে দেখি, পিতা যাঁকে হত্যা করতে চায়, এমন সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থায় একমাত্র ভগবানই ছিল ধ্যানজ্ঞান। সেই ভগবান শ্রীহরি প্রহ্লাদকে রক্ষা করতে তাঁর বাবা হিরণ্যকশিপুকে ব্রহ্মার দেয়া বরদান মাথায় রেখে নৃসিংহদেব রূপে আবির্ভূত হয়ে ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করেছিলেন।
এ জগত একটি বৃহত্তম মহিমান্বিত নকশা। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই এ নকশাটি ক্রিয়াশীল। ঈশ্বরই জগতের সকল ভ্রান্তিহরণ করে মহাকালের বৃত্তাকার গতিপথকে সচল রাখনে। তিনি আকাশে মেঘের মত অনন্ত, তাই তার গায়ের বর্ণ শ্যাম।
বিভিন্ন অবতার রূপে তিনি জগতকে রক্ষা করেছেন এরমধ্যে শ্যাম এবং রাম অবতার প্রধানতম। তাই এ দুই অবতারকেই প্রধানত আমরা পূজা করি। অন্য সকল অবতার কোন একটি বিশেষ নিদিষ্ট করনীয় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু রাম শ্যাম অবতারে মানব জীবনের পারিবারিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সমানভাবে নিজে আচরণ করে লোকশিক্ষা দিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাই তাঁরা ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির দুই কেন্দ্রীয় পুরুষ।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন ধর্ম, ন্যায় এবং কর্তব্য পালনের এক জাজ্বল্যমানতার পরাকাষ্ঠা। তাই তিনি সকল মানবের আদর্শ, মর্যাদা পুরুষোত্তম। তিনি পিতৃসত্য রক্ষার জন্যে চৌদ্দবছর বনবাস সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ম পালনে ছিলেন আপোষহীন। সাধু সজ্জনের কাছে তিনি ছিলেন কুসুমের মত কোমল, আবার দুর্জ্জন অধর্মের বিনাশে তিনি নির্মম বজ্রধর । রামায়ণের অসংখ্য স্থানে ধর্মের মাহাত্ম্য এবং অধর্মকে বিনাশ করে ধর্মের শরণে থাকার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ জগতে ধর্মই প্রকৃত সারবস্তু। তাই ধর্মের শরণে থাকার চেষ্টা আমৃত্যু করা উচিত। রাম শব্দের অর্থ আনন্দ। রাম ভগবানের আনন্দময় প্রকাশ।
স্বয়ম্ভু জগতপিতা হয়েও ভগবান নিজ ইচ্ছাবশে লীলা পুরুষোত্তম রূপে ব্রজবালকদের ও অর্জুনের
মত সুআচরণকারীদের আনন্দ দান করেছেন এবং তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশেছেন।
“যখন যখন ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয়ে জগতে ক্ষোভের উৎপত্তি হয়েছে, জন্মরহিত হয়েও যিনি লোকনায়করূপে আবির্ভূত হয়ে ধর্মকে রক্ষা করেছেন। যিনি অবিনশ্বর, জগতের বিধানকর্তা, যিনি সর্বপ্রকার বিকারশূন্য শুদ্ধ স্বচ্ছ, বেদাদি শাস্ত্রে যাঁর গুণগানই বর্ণিত আছে, যিনি ব্রজপতি।যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।”
“যদা ধর্মগ্লানির্ভবতি” এ বাক্যটি শ্রীমদ্ভগবদগীতা থেকে নেয়া। সেখানে ভগবান সুস্পষ্টভাবে বলেছেন:
“যখন যখনই ধর্মের গ্লানি হয়ে অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি, অর্থাৎ সাকাররূপে অবতীর্ণ হয়ে জনসমক্ষে প্রকটিত হই। এভাবেই যুগে যুগে সাধুদের পরিত্রাণ করি এবং দুষ্কৃতীদের বিনাশ করে ধর্মসংস্থাপন করি।”
লোকনায়করূপে অবতীর্ণ হয়ে ভগবান অধর্মের বিনাশ করে ধর্মের সংস্থাপন করেন।তিনিই এ জগতের মূলাধার। বেদাদি সকল শাস্ত্রে এ অচিন্ত্য পরমেশ্বরেরই মাহাত্ম্যগীত বর্ণিত আছে। সংগীত ভগবানে অত্যন্ত প্রিয়, তাই এটি সাধনার একটি অঙ্গ। নামদেব, তুকারাম, নরসিং মেহতা, মীরা বাই, সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি অনেক বড় সাধকেরা সংগীতের মাধ্যমেই ভগবানের উপাসনা করে ভগবানের দর্শন পেয়েছেন। গীতার মধ্যে আছে, “বেদানাং সামবেদোঽস্মি”-(১০.২২)। বেদের মধ্যে স্বরগীত সহ গেয় সামগান ভগবানের প্রিয়। এ সামগানগুলির মধ্যে বৃহৎসাম নামে একটি গীতি আছে যেখানে ইন্দ্ররূপি পরমেশ্বরের স্তুতি করা আছে সেই গীতগুলিকে ভগবান তাঁর বিভূতি বলে গীতাতে জানিয়েছেন-” বৃহৎসাম তথা সাম্নাং”(১০.৩৫)। অর্থাৎ সামবেদের মধ্যে তিনি গীতযোগ্য বৃহৎসাম।
“এভাবে শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর মাতার মোক্ষের জন্যে জগতের পরমেশ্বর শ্রুতিবর্ণিত গুণসম্পন্ন স্তোত্র দ্বারা আদিপুরুষ শ্রীহরির আরাধনা করলে, তিনি দেহধারণপূর্বক সাকাররূপ পরিগ্রহ করে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম হাতে শ্রীস্বরূপা লক্ষ্মীদেবীকে নিয়ে যতিরাজের সামনে আবির্ভূত হলেন।”
শঙ্করাচার্য তাঁর সন্ন্যাসকালে মাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি যেখানেই থাকেন মায়ের অন্তিমকালে উপস্থিত হবেন। তিনি তাঁর কথা রাখেন। মা বিশিষ্টা দেবীর অন্তিমকালে উপস্থিত হয়ে মাকে তাঁর আরাধ্য গৃহদেবতা শ্রীহরিকে দর্শন করান। শঙ্করাচার্যের শ্রুতিবর্ণিত গুণসম্পন্ন অষ্টশ্লোকে প্রসন্ন হয়ে ভগবান নারায়ণ লক্ষ্মীদেবী সহ শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম হাতে চতুর্ভুজ মূর্তিতে শঙ্করাচার্যের শয্যাশায়ী মৃত্যুপথযাত্রী মাতৃ সম্মুখে আবির্ভূত হন। স্তোত্রটিতে বারবার শ্রুতির কথা বলা হয়েছে ।
শ্রীশঙ্করাচার্য শ্রুতি প্রতিপন্ন ভাষা ছন্দ ব্যবহার করে ভগবানকে আকর্ষণ করেছেন। ভগবানও দর্শন দিয়েছেন। এ স্তোত্রটিতে প্রত্যেকটি শ্লোকের শেষে ধ্রুবপদ হিসেবে একটি পাদ বারবার আবর্তিত হয়েছে। এ পাদটিই এ স্তোত্রের মূল শক্তি।শরণ্যো লোকেশো মম ভবতু কৃষ্ণোঽক্ষিবিষয়ঃ ; অর্থাৎ যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র শরণ্য ঈশ্বর, সেই কৃষ্ণচন্দ্র দয়া করে আমার নয়নগোচর হোন।ডাকার মত ডাকতে পারলে ভগবান যে আসেন, থাকেন, কৃপা করেন এবং ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন এর অনেক উদাহরণ আমরা শাস্ত্রে পাই। এ স্তোত্রটিও তেমনি একটি উদাহরণ। ভাবতে অবাক লাগে শঙ্করাচার্য কত বড় একজন ভক্ত ছিলেন যে, যাঁর অষ্টশ্লোকের দৈবী আহ্বানে ভগবানও দর্শন দিয়ে তাঁর মাকে মুক্ত করেছেন।