গুর্জর-প্রতিহার রাজবংশ
যেসব ইতিহাসবিদ ভারতীয় শিলালিপি ও অভিলেখের সাক্ষ্যে বিশ্বাস করেন না, তারা উনবিংশ শতকের শুরুতে বিদেশী ভারতবিদদের (ইন্ডোলজিস্ট) দ্বারা প্রচারিত ‘মিথে’ বিশ্বাস রাখেন। এরকম একজন ‘ইন্ডোলজিস্ট’ হচ্ছেন কর্নেল জেমস টড, যিনি রাজস্থানের কোনও একটি দেশীয় রাজ্যের ব্রিটিশ অফিসার হিসাবে কাজ করতেন। টড বিরচিত গ্রন্থের ভাষ্য অনুসারে চাহমান, পারমার, চালুক্য ও প্রতিহাররা নাকি আবু পর্বতে যজ্ঞকুণ্ড থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। অবশ্য জেমস টড স্বীকার করেছিলেন, তিনি এই তথ্য পেয়েছেন চন্দবরদাই বিরচিত পৃথ্বীরাজরাসৌ গ্রন্থ থেকে; যা ত্রয়োদশ শতকে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। জেমস টড তার গ্রন্থে লিখেছেন এই তথ্য থেকে এটাই প্রমাণিত হয় উপরোক্ত চার রাজবংশ বিদেশী কুলোদ্ভব। কেননা প্রাচীনকালে হিন্দুরা বিদেশীদের অগ্নি দ্বারা শুদ্ধ প্রক্রিয়া করে তাদের স্বধর্মে দীক্ষা দিতেন।
এটা প্রমাণিত বিদেশ থেকে বহুবার অনুপ্রবেশকারী জাতি ভারতে এসেছে বিভিন্ন কারণে, শেষে তারা হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু টডের গুর্জর-প্রতিহার সম্পর্কে এহেন চিন্তাধারা সম্ভবত সঠিক নয়। কারণ গুর্জর-প্রতিহারদের মধ্যে কোনও বিদেশী আচার বিচার নেই, যা ধর্মান্তরিত হলেও ক্ষীণভাবে থাকবেই। বিদেশী অনুপ্রবেশকারী বলতে সম্ভবত হূণদের বোঝানো হচ্ছে। টড বা তার স্বজাতীয় ইতিহাসবিদরা এও দাবি করেন যে, হূণদের সাথে আরেকটা বহিরাগত জাতি ভারতবর্ষে খৃষ্টীয় চতুর্থ শতকে এসেছিল; যারা নিজেদের খাজার বলত।
এরা সম্ভবত হূণদের আগে, বা পরে ভারতে এসেছিল, কালান্তরে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে শেষে আদ্যোপান্ত ভারতীয় জাতিতে রূপান্তরিত হয়। এরকম অদ্ভুত দাবি যারা করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হচ্ছে ক্যাম্পবেল এবং জ্যাকসন। দুজনেই বোম্বাই গেজেটিয়ার (১:১:৩:৭২) গ্রন্থে খাজারদের গুর্জর হিসাবে দাবি করেছিলেন। কিন্তু নামটুকু ছাড়া এমন কিছুর ঐতিহাসিক প্রমাণ আনতে পারেন নি, যাতে মনে করা যেতে পারে তাদের দাবি সঠিক। প্রথমত, খাজার যে হূণদের কোনও শাখা ছিল কিনা তার উত্তর পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, খাজারদের সাথে কুশানদের পূর্বপুরুষ ইউমচি জাতির সম্পর্ক আছে কিনা, তাও নিশ্চিত ভাবে বলা চলে না। শুধুমাত্র ধ্বনিগত সাদৃশ্যের কারণে গুর্জরদের সাথে খাজারদের মেলানো বোকামি। অথবা চিরাচরিত ব্রিটিশ সুলভ ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ গোছের প্রোপ্যাগান্ডা।
খাজার নামক উক্ত বিদেশী জাতি হূণদের সাথে বা স্বতন্ত্র ভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল কিনা, সেটার প্রমাণ কোনও বিদেশী বা ভারতীয় অভিলেখ বা লিপিতে সাক্ষ্য হিসাবে পাওয়া যায় না। অনেকে এমনও দাবি করেন বিদেশীরা শুধু খাইবার গিরিপথ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল তা নয়, নৌপথ হয়েও ভারতের পশ্চিম উপকূলে এসে অনুপ্রবেশ করেছিল। সবচেয়ে বড় কথা আদি গুর্জরদের উচ্চতা, শারীরিক গঠন, এদের নামকরণ দেখে মনে হতে পারে এরা ভারতীয় না। আদি গুর্জর শাসকদের মধ্যে দুটি নাম উল্লেখযোগ্য — রোহিল্লাধি ও পেল্লোপেল্লি।
এরকম নাম ভারতীয়দের মধ্যে সেভাবে প্রচলিত নয়।
তবে ইউরোপীয় ইন্ডোলজিস্টদের মধ্যে এভাবে জোর করে খাজারদের সাথে গুর্জরদের মিলিয়ে দেওয়ার অভ্যাস দেখে মনে করা যেতে পারে, এরা আসলে এভাবে নিজেদের বৈধ শাসক হিসাবে প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছিল — যদি বিদেশীরা গুর্জর-প্রতিহার হয়ে পশ্চিম ভারত শাসন করতে পারে; তবে আমরা কেনই বা ইউরোপীয় হয়েও ভারত শাসন করতে পারব না। এই একই চিন্তাধারা থেকেই তারা আর্য অনুপ্রবেশের তত্ত্ব তৈরি করেছিল, যা পরবর্তীকালে ভুয়ো প্রমাণিত হয়েছে। ভাণ্ডারকর, ত্রিপাঠীর মত কিছু ভারতীয় ইন্ডোলজিস্ট রাজপুতদের বিদেশী কুলোদ্ভব বলে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে চ.ভ. বৈদ্য, গৌরিশঙ্কর হীরাচাঁদ, রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ইতিহাসবিদরা সে সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছেন।
পর্ব: ২
প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।
তথ্যসূত্রঃ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশুদ্ধানন্দ পাঠক।
লেখা: অয়ন চক্রবর্তী।