স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন “ … এই পরানুবাদ, পরমুখাপেক্ষা, দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা- এই মাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?…… “
আমাদের উচ্চাধিকার লাভ করার মূল অন্তরায় পরাণুকরণ। সাতশো বছরের পরাধীনতার রাহুগ্রাস থেকে আমরা ধীরে ধীরে মুক্তি পাচ্ছি। তারই এক ঝলক দেখা গেল ২০২৩ এর পয়লা জানুয়ারি ত্রিবেণীতে।একটু খোলসা করে বলি।

গঙ্গা-যমুনা(কুন্তি)-সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল হুগলী জেলার ত্রিবেণী। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আছে, মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে/ আমরা বাঙ্গালী বাস করি সেই তীর্থে-বরদ বঙ্গে- ……।।
এই মুক্তবেণী তীর্থই ত্রিবেণী সঙ্গম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই গৌড় বাঙ্গলার পবিত্র এই তীর্থক্ষেত্র দর্শন করতে আসতেন হাজার হাজার পূর্ণার্থি। দ্বাদশ শতকে গৌড় বাঙ্গলার ভুরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি এখানে বিখ্যাত শ্মশান ঘাটসহ গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলে ঘাট নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। বৈষ্ণব ও শাক্ত পীঠের এই স্বাধিষ্ঠানে পদস্পর্শ করেছেন স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব।
বহু প্রাচীন কাল ধরে ভারত বর্ষের বিভিন্ন আখাড়ার সাধু সন্তেরা মকর সংক্রান্তি তিথিতে গঙ্গাসাগরে কপিল মুণির আশ্রমে পবিত্র অবগাহনের পর এক মাস ধরে মৌনব্রত পালন করতে ত্রিবেণীতে আসতেন। এরপর মাঘী সংক্রান্তি তিথিতে গঙ্গা যমুনার সরস্বতী মুক্ত ত্রিধারায় পবিত্র স্নান সেরে যে যার আশ্রমে ফিরে যেতেন । প্রতি বৎসরের এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব কুম্ভস্নান নামে খ্যাত। প্রয়াগরাজ, হরিদ্বার, নাসিক ও উজ্জয়নীর বারো বৎসর অন্তর কুম্ভ ছাড়াও শাস্ত্রে বছরকালের এই কুম্ভের কথাও রয়েছে।
ত্রিবেণী সঙ্গমের অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে এবং বাণিজ্য নগর সপ্তগ্রাম নিকটে থাকায় নিজের রাজধানি স্থাপনের উদ্দেশ্যে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহের সেনাপতি জাফর আলি খান স্থানীয় শাসক কে পরাজিত করে ত্রিবেণী দখল করেন। ইসলামি শাসকের রীতি অনুযায়ী বিষ্ণু মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তরিত করে বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন এই সনাতনী ঐতিহ্যের। জাফর গাজি প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও দরগা ই গৌড় বঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় ইমারত ভেঙ্গে ইসলামি স্থাপত্য তৈরির প্রথম নিদর্শন।
মার্কিণ প্রবাসী কৃতি বাঙ্গালী শ্রীকান্ত মুখোপাধ্যায়, কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবল গুপ্তের মতোন বেশ কয়েকজনের উৎসাহে এবং এই বঙ্গের সনাতনী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ কয়েকজন উৎসাহী বাঙ্গালীর মিলিত প্রচেষ্টায় দীর্ঘ সাতশো দুই বছর পর শুরু হয়েছে আবার ত্রিবেণী কুম্ভ। বাঙ্গালীর হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার এক দুঃসাহসী কাজ শুরু হয়েছে দুর্বার গতিতে।
গত পয়লা জানুয়ারি কল্পতরুর পবিত্র দিনে একাধিক সাধু সন্তের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হল “ভূমি পূজন” অনুষ্ঠানের।
এই ভূমি পূজা কোনো নির্মাণ কার্যের জন্য নয়। বরং দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে আগত সাধু সন্তেরা যে পবিত্র ধ্বজের নীচে সমবেত হবেন, ধর্ম সংসদে মিলিত হয়ে সমাজ, শাস্ত্র, বিশ্ব শান্তি নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করবেন, যাগ যজ্ঞের মাধ্যমে সেই গৈরিক ধ্বজ ই উত্তোলন করা হল কল্পতরু দিবসে।
মহানির্বাণ মঠের মহামণ্ডলেশ্বর গৌর রামানুজ, নোয়াপাড়া রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মোহান্ত মহামণ্ডলেশ্বর পরমাত্মা নন্দজী মহারাজ, সপ্তগ্রামের বিধায়ক ও রাজ্যের মন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত, বাঁশবেড়িয়ার পুরপিতা আদিত্য নিয়োগী, মার্কিণ প্রবাসী দেবল গুপ্ত, ঐতিহাসিক অশোক গাঙ্গুলি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাধন মুখোপাধ্যায়, বহু সাধু সন্ন্যাসী, পুরসভার নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ ও স্থানীয় বহু মানুষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সপ্তম শতকে আদি শংকরাচার্য্য দেবভূমি কামাখ্যা, শ্রীক্ষেত্র, গয়া উদ্ধার করে সনাতনী হিন্দু সমাজকে পুনর্জাগরিত করেছিলেন। মহাকুম্ভে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের সাধুসন্তের ধর্ম সংসদ কে পুনঃ:স্থাপন করার কৃতিত্ব তাঁর ই।
গত বছর করোনা অতিমারি সত্বেও বহু সাধু সন্তসহ প্রায় তিন লক্ষ পূর্ণার্থি ত্রিবেণী কুম্ভের সমবেত হয়েছিলেন ৭০২ বছর পর। এ বছর এই সংখ্যা দশগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবন। এজন্য চলেছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ত্রিবেণীর এই কুম্ভ উৎসব বাঙ্গালীর হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার হওয়ার অপেক্ষায়, এমনই আশা ত্রিবেণীবাসীর।
লেখা: প্রবীর ভট্টাচার্য্য।