স্বামী বিবেকানন্দ, এক প্রেরণার নাম।
১৮৯৩ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বরে আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ধর্ম মহা-সম্মেলন যেখানে হিন্দুধর্মের বক্তা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন তৎকালীন তরুণ ভারতীয় সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। সেদিনের সে তরুণ সন্ন্যাসী আজও লক্ষকোটি তরুণের আদর্শ, তিনি আজও একইরকমভাবে প্রাসঙ্গিক। বেদ-বেদান্তের আলোকে যে বিশ্বমানবতার শিক্ষা স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা আজও বহু মানুষকে মোহিত করে যাচ্ছে অবিরত। এজন্যই হয়তো তাঁকে বলা হয় “An Iconic Religious Leader” যিনি একজন হিন্দু সন্ন্যাসী হয়েও বিশ্বসভায় বিশ্বমানবতার পক্ষে স্পষ্ট বাক্য উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। তিনিই একমাত্র ভারতীয় সন্ন্যাসী যিনি বেদান্তদর্শনের চিরন্তন ও শ্বাশত শিক্ষাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
তিনি শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে সেদিন দাঁড়িয়ে সকল ধর্মীয় পরিচয়ের উপরে গিয়ে সকলকে আপন করে নিয়ে বলেছিলেন, “Dear Brothers and Sisters of America…… ” সেখানে উপস্থিত প্রায় ৭০০০ শ্রোতার প্রত্যেকেই সেদিন ২ মিনিট ধরে কেবল হাততালিই দিয়েছিলেন স্বামীজিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে।
সেদিনের সে ভাষণে স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের বিশ্বজনীন দর্শনকে গর্বের সাথে বিশ্বসভায় তুলে ধরে বলেছিলেন, “I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance.”
স্বামী বিবেকানন্দই সেই ব্যাক্তি যিনি হিন্দুদর্শনের সারতত্ত্বকে এক বাক্যে প্রকাশ করে বলেছিলেন,
“জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর।”
বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনের সেদিনের সে ভাষণ আমেরিকার জনগণকে এতোটাই বিমোহিত করেছিলো যে দ্য নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড তাদের প্রচারিত সংবাদে উল্লেখ করেছিলো,
“বিবেকানন্দ নিঃসন্দেহে ধর্ম সংসদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বক্তব্য ছিলো অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক।”
স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে ধর্ম সংসদের সভাপতি জন হেনরি ব্যারোস বলেছিলেন, “ভারতবর্ষ, ধর্মের জননীস্বরূপ ছিলেন বিবেকানন্দ, কমলা রঙের পোশাক পরিহিত এই সন্ন্যাসী তাঁর শ্রোতাগণের উপর সবচেয়ে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলেছিলেন।”
১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সে মহাসম্মেলনের পর থেকে ভারতীয় সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন বিশ্বজনীন এক অনুপ্রেরণার নাম। পশ্চিমা দেশগুলোতে বেদান্তদর্শনের উপর স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিটি আলোচনা অনুপ্রাণিত করেছিলো বহু দার্শনিক, সাহিত্যিক ও গবেষককে।
বিবেকানন্দ আমেরিকা এবং ইউরোপে তাঁর অসাধারণ বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনায় আকর্ষণ করেছিলেন জোসেফাইন ম্যাকলিড, উইলিয়াম জেমস, জোসিয়া রইস, রবার্ট জি ইনজারল, নিকোলা টেসলা, লর্ড কেলভিন, হ্যারিয়েট মনরো, এলা হুইলার উইলকক্স, সারাহ বার্নহার্ট, এমা ক্যালভ এবং হারমান লুডভিগ ফারডিনানড ভন হেলহোল্টজ, রোঁমা-রোঁলা এবং পল ডিউসেনের মতো ব্যক্তিদেরকে।
তিনি বেশ কয়েজন অনুগামীকে দীক্ষিতও করেছিলেন: মেরি লুইস (ফরাসি) হয়েছিলেন স্বামী অভয়নন্দ এবং লিওন ল্যান্ডসবার্গ স্বামী কৃপানন্দ হয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ তাদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করলেন “বেদন্ত সোসাইটি”। এই সমাজটি এখনও বিদেশী নাগরিকদের দ্বারা পরিপূর্ণ এবং এটি অবস্থিত লস এঞ্জেলেসে যা এখনও বহু দিশাহীন মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।
বিবেকানন্দের বক্তব্য শুনে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর ড উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন, “লোকটি বক্তৃতাশক্তি সত্যিই একটি আশ্চর্য, তিনি মানবতার জন্য সম্মান”
স্বামী বিবেকানন্দকে দুটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি); তিনি উভয়ই অস্বীকার করেছিলেন, যেহেতু তিনি একজন সন্নাসী এবং এই পদ তাঁর প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার সাথে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে।
স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্তদর্শন বিষয়ক আলোচনা প্রভাবিত করেছিলো মডার্ণ টেকনোলজির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক নিকোলাস টেসলাকেও৷ এই তথ্য পাওয়া যায় “নিকোলাস মেমোরিয়াল সোসাইটি” এর ওয়েবসাইটে। বেদান্তদর্শনের আলোকে ভর-শক্তি নিয়ে টেসলার গবেষণা তিনি স্বামী বিবেকানন্দকে দেখাতেও চেয়েছিলেন। এই ঘটনার উপর পশ্চিমা বিজ্ঞানী টবি গ্রটস-এর একটি প্রবন্ধ “মাউন্টেন ম্যান গ্রাফিকস, অস্ট্রেলিয়া – সাউদার্ন অটাম অফ ১৯৯৭” এ পাব্লিস হয়৷ নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমসাময়িক আরেকজন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোঁমা-রোঁলাকে একবার এক চিঠিতে লিখেন, “তুমি যদি ভারতকে জানতে চাও তবে বিবেকানন্দকে পড়ো/জানো”। নোবেলজয়ী রোঁমা-রোঁলা তারপর বিবেকানন্দকে জেনেছিলেন এবং লিখেছিলেন এক বিখ্যাত গ্রন্থ “The Life of Vivekananda and The Universal Gospel.”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লিখেন,
“কিছুদিন আগে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি; বলেছিলেন দরিদ্রের মধ্য দিয়ে নারায়ণ আমাদের সেবা পেতে চান। একে বলি বানী। এই বানী স্বার্থবোধের সীমার বাইরে মানুষের আত্মবোধকে অসীম মুক্তির পথ দেখালে। এতো কোন বিশেষ আচারের উপদেশ নয়। …… সংকীর্ণ অনুশাসন নয়। ছুঁৎমার্গের বিরুদ্ধতা এর মধ্যে আপনিই এসে পড়েচে, –
তার দ্বারা রাষ্ট্রিক স্বাতন্ত্র্যের সুযোগ হতে পারে বলে নয়, তার দ্বারা মানুষের অপমান দূর হবে বলে, সেই অপমানে আমাদের প্রত্যেকের আত্মাবমাননা। বিবেকানন্দের এই বানী সম্পূর্ণ মানুষের উদ্বোধন বলেই কর্ম্মের মধ্যে দিয়ে ত্যাগের মধ্যে দিয়ে মুক্তির বিচিত্রে পথে আমাদের যুবকদেরকে প্রবৃত্ত করেচে।”
নোবেলজয়ী ফ্রেঞ্চ নাট্যকার, সাহিত্যিক, উপন্যাসিক ও ইতিহাসবিদ রোঁমা রোঁলাও স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “স্বামী বিবেকানন্দের চারিত্রিক শ্রেষ্ঠতা ছিলো রাজার মতো এবং তিনি ছিলেন জন্মগত রাজা। তাঁর মহিমাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে কেউ তাঁর নিকটে আসতে পারবে না সে আমেরিকার হোক বা ভারতের। স্বামীজিকে কখনও দ্বিতীয় স্থানে কল্পনা করা যায় না কারণ তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই তিনি প্রথম আকর্ষণ থাকতেন স্বয়ং ঈশ্বর দ্বারা নির্বাচিত নেতা।”
স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক পল ডিউসেন। তিনি পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বেদান্তের উপর কাজও করেন। তিনি ৬০ টি উপনিষদের সংকলন নিয়ে একটি বই লিখেন, “Sechzig, Upanishads Des Veda”
জামসেটজি টাটা বিবেকানন্দের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় “ভারতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট”।
স্বামী বিবেকানন্দ যে ক্ষয়িষ্ণু ভারতবর্ষের নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল চক্রবর্তী রাজ গোপালচারীর একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, “বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্ম বাঁচিয়েছিলেন, ভারতকে বাঁচিয়েছিলেন।”
এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রমানিত হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে তেজস্বী পুরুষ নেতাজী সুভাষ বসুর বক্তব্যে। তিনি বলেন, “বিবেকানন্দ ছিলেন আধুনিক ভারতের নির্মাতা।” নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সেই ব্যক্তিটিও স্বামী বিবেকানন্দ।
স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে লিখতে গেলে হয়তো কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ক্ষুদ্র জীবনে যা যা কীর্তি স্থাপন করে গেছেন তা লিখে শেষ করা যাবে না।
কিছু বামপন্থী ও অনার্য জাতিগোষ্ঠী যদিও স্বামীজির সময়কাল থেকেই তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের খণ্ডিতাংশ প্রেক্ষাপট যাচাই না করে প্রচার করে তাঁর চরিত্রহননের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের স্থান আজও হিমালয়ের মতোই সুউচ্চ। এ নিয়ে নোবেলজয়ী ফ্রেঞ্চ নাট্যকার, সাহিত্যিক, উপন্যাসিক ও ইতিহাসবিদ রোঁমা রোঁল তাই বলেছিলেন, “স্বামী বিবেকানন্দের অপপ্রচারে সবসময়ই ব্যস্ত থাকে তাঁর বিরোধীগোষ্ঠী।”
স্বামী বিবেকানন্দকে জানতে ও বুঝতে “স্বামী বিবেকানন্দের বানী ও রচনা”র সবগুলো খণ্ডের আদ্যোপান্ত ও “যুগনায়ক বিবেকানন্দ” পড়ে নিন, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে যাবে।
আজ ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মজয়ন্তী। আমার আদর্শিক গুরুর শ্রীচরণকমলে আমার শতকোটি নমস্কার।
লেখা: শ্রী অনিক কুমার সাহা