এই ভূখণ্ডের সর্বজনীন শব্দ 'শ্রী' - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • May 29, 2023
  • Last Update April 29, 2023 5:58 pm
  • kolkata

আজ থেকে প্রায় ষাট বা সত্তর বছর আগেও হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালিই নামের আগে শ্রী শব্দটি ব্যবহার করত। শ্রী ছিল এই অঞ্চলের একটি সর্বজনীন সৌন্দর্যবাচক শব্দ। শ্রী শব্দটি স্ত্রীবাচক (√শ্রী+ক্বিপ্) নিষ্পন্ন। যিনি জগতের আধার হরিকে আশ্রয় করেন, তিনিই শ্রী বা লক্ষ্মী। শ্রী শব্দটির বিবিধ অর্থ: বাণী, ঐশ্বর্য, জাগতিক সমৃদ্ধি, বুদ্ধি, বৃদ্ধি,কীর্তি, উদয়, প্রভা, দীপ্তি, সৌন্দর্য, সিদ্ধি এবং ধর্ম-অর্থ-কামের সম্মিলনে ত্রিবর্গ । আফগানিস্তান (গান্ধার) থেকে ইন্দোনেশিয়া (যবদ্বীপ), ব্রুনাই, ভিয়েতনাম সর্বত্রই পবিত্র শ্রী শব্দটি ব্যবহৃত হত। মালয়েশিয়াতে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় সহ সকলেই শ্রী শব্দটি আজও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নামের পূর্বে ব্যবহার করে। বিষয়টি সে দেশের মন্ত্রী এমপি সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামের দিকে লক্ষ্য করেলেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। মালয়েশিয়ায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দাতু শ্রী নাজিব রাজ্জাকের নাম দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া যায়। মালয়েশিয়ায় পার্শ্ববর্তী অধুনা মুসলিম রাষ্ট্র ব্রুনাইয়ের রাজধানীর নামের সাথে বর্তমানেও শ্রী শব্দটি ব্যবহৃত – ‘বন্দর শ্রী ভগবান’ (বন্দর শিরি ভগওয়ান)। বৃহত্তর ভারতবর্ষ তো বটেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রত্যেকটা ভাষাতেই জাতিধর্মনির্বিশেষে শ্রী শব্দটি আজও প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয়।

১. মায়ানমারের বর্মী ভাষায়: သီရိ (thiri)
২.ইন্দোনেশীয় ভাষায়: শ্রি
৩.খ্‌মের ভাষায়: ស្រី (Srey) and សេរី (Serey)
৪. লাওসের লাও ভাষায়: ສີ (Si) and ສຣີ (Sri)
৫. মালয়েশিয়ার মালয় ভাষায়: سري (Seri)
৬. থাইল্যান্ডের থাই ভাষায়: ศิริ (Siri) and ศรี (Sri or Si)
৭. কম্বোডিয়ার চাম ভাষায়: Chế

শ্রী শব্দটি সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন সংহিতায় ‘শ্রীসূক্ত’ আছে। সেখানে লক্ষ্মী স্বরূপা মহাদেবী শ্রীর মাহাত্ম্য অসাধারণ শব্দ ব্যঞ্জনায় বর্ণিত হয়েছে।ঋগ্বেদের শ্রীসূক্তে বলা হয়েছে, ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য সম্পদ, আরোগ্য সম্পদ, সৌন্দর্য সম্পদ সহ সকল সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী এবং দাত্রী হলেন শ্রীদেবী। একারণে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পাশে সর্বদা শ্রীদেবীকে দেখা যায়।

ওঁ হিরণ্যবর্ণাং হরিণীং সুবর্ণরজতস্রজাম্ ।
চন্দ্রাং হিরণ্ময়ীং লক্ষ্মীং জাতবেদো ম আবহ ॥
তাং ম আবহ জাতবেদো লক্ষ্মীমনপগামিনীম্ ।
যস্যাং হিরণ্যং বিন্দেয়ং গামশ্বং পুরুষানহম্ ॥
অশ্বপূর্বাং রথমধ্যাং হস্তিনাদপ্রবোধিনীম্ ।
শ্রিয়ং দেবীমুপহ্বয়ে শ্রীর্মাদেবীর্জুষতাম্ ॥
কাং সোস্মিতাং হিরণ্যপ্রাকারামার্দ্রাং জ্বলন্তীং তৃপ্তাং তর্পয়ন্তীম্ ।
পদ্মে স্থিতাং পদ্মবর্ণাং তামিহোপহ্বয়ে শ্রিয়ম্॥
চন্দ্রাং প্রভাসাং যশসা জ্বলন্তীং শ্রিয়ং লোকে দেবজুষ্টামুদারাম্ ।
তাং পদ্মিনীমীং শরণমহং প্রপদ্যেঽলক্ষ্মীর্মে নশ্যতাং ত্বাং বৃণোমি॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা : আশ্বলায়ন শাখা, ৫.৮৮.১-৫)

“হে জাতবেদ অগ্নিদেব! সুবর্ণবর্ণা, হরিণীর মত চঞ্চল, সোনা এবং রূপার বিবিধ মালায় বিভূষিত ; পূর্ণিমার চন্দ্রের মত প্রকাশমানা, হিরণ্ময়ী লক্ষ্মীকে আমার জন্য আহ্বান করুন।

হে জাতবেদ অগ্নিদেব! নিম্নগমনরোধকারী সেই লক্ষ্মীকে আমার জন্য আহ্বান করুন। যিনি আহূতা হলে আমি স্বর্ণ, গো, অশ্ব, পুত্র মিত্রাদি প্রাপ্ত হব।

অশ্ব যাঁর পুরােভাগে, রথাসীনা হস্তীর বৃংহণ নাদ দ্বারা যিনি প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাপিকা; সেই শ্রীদেবীকে আমার নিকট আহ্বান করুন, তিনিই আমাকে কৃপা অনুগ্রহ করবেন।

ব্রহ্মারূপা, স্মিতহাস্যকারিনী, সুবর্ণাদির দ্বারা পরিবেশিষ্টা, আর্দ্রা, প্ৰকাশমানা, প্রসন্নবদনা, ভক্তের মনােবাঞ্ছাপূর্ণকারিণী, পদ্মাসীনা, পদ্মবর্ণা সেই শ্রীদেবীকে আহ্বান করি।

চন্দ্রের ন্যায় প্রভাসম প্রকাশমানা, নিজ যশে প্রজ্জ্বলিত, জগতের শ্রীস্বরূপা, ইন্দ্রাদিদেবসেবিতা, পদ্মিনীর শরণ গ্রহণ করছি। হে শ্রীদেবি! আমার দুর্ভাগ্যসূচক অলক্ষ্মী বিনষ্ট হােক, আমি তোমার শরণ নিলাম।”

কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দুরা যেভাবে শ্রী শব্দটিকে তাদের জীবন থেকে বিদায় করে দিয়েছে, এতেই হয়ত দিনেদিনে তারা শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এর পিছনে রাষ্ট্রযন্ত্র যারা পরিচালনা করে তাদেরও সুনির্দিষ্ট ইন্ধন রয়েছে। হুসেন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে আশির দশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রী শব্দটি বাদ দেয়া শুরু হয় বিভিন্ন স্থান থেকে। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে নামের আগে শ্রী শব্দটি কেটে দেয়ার একটি অলিখিত সরকারি নির্দেশনা ছিল। এমনকি কারো নাম যদি শ্রীকান্ত হয় তবে তার নামের শ্রী শব্দটিও শিক্ষা বোর্ড থেকে কেটে শুধুমাত্র কান্ত করে দেয়া হয়েছে এরকম বহু তথ্যই জানা যায়। বৃহত্তর বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের পরেই শ্রীশব্দটি হিন্দুয়ানী বলে পরিহার শুরু করে। এর পরবর্তী কালের প্রবাহে বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক প্রচারণার ফলে শ্রীশব্দটি শুধুই বাঙালি হিন্দুর পরিচয়ে পরিণত হয়। আশির দশকে এসে দেশের শিক্ষা বোর্ড শ্রী শব্দটি হিন্দু সম্প্রদায়ের নামের থেকে অনৈতিকভাবে বাদ দিতে থাকে। শিক্ষা বোর্ড যেহেতু শ্রীশব্দটিকে পরিহার করছে, তাই এর অভিঘাতে যেচে পরেই তখন শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা অহেতুক ঝামেলা এড়াতে নিজেরাই তাদের সন্তানদের নামের সাথে শ্রী শব্দটিকে পরিহার করে।

অথচ শ্রী শব্দটি হল এই ভূখণ্ডের একটি সর্বজনীন পরিচয়ের সৌন্দর্যবাচক শব্দ। দেশের পুরানো পরচা, দলিলপত্রে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের নামের সাথে আজও শ্রী শব্দটিকে পাওয়া যায়। এমনকি আশি থেকে নব্বই বছর আগেও মুসলিম মাওলানা এবং পুঁথি লেখকদের নামের সাথে অবাদে শ্রী শব্দটি ব্যবহৃত হত। এরকম অনেক পুঁথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহীত অসংখ্য ইসলামি পুঁথিতেও বিষয়টি দেখা যায়।আজ এই ভূখণ্ডের সৌন্দর্যবাচক শ্রী শব্দটিকে হটিয়ে হিন্দু সরকারি চাকুরিজীবীদের নামের সাথে বর্তমানে লেখা হয় পুরুষের ক্ষেত্রে জনাব এবং নারীদের ক্ষেত্রে বেগম শব্দদ্বয়। অথচ হিন্দু পুরুষের নামের ক্ষেত্রে শ্রীশব্দটি থাকার কথা এবং নারীদের নামের সাথে শ্রী, শ্রীমতী বা সুশ্রী শব্দের ব্যবহার থাকার কথা। কিন্তু কোনমতেই বৈদেশিক পার্সিয়ান শব্দ জনাব বা বেগম নয়। হিন্দু নারীদের নামের সাথে বেগম শব্দটির রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহারে অনেকেই দেখেছি বিভিন্ন সময়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তবে এ বিষয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠ অত্যন্ত ক্ষীণ হওয়ার সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহার হয়েই চলছে। ইতিহাসে পাঠে জানা যায়, মুগল বাদশাদের প্রাসাদ এবং হেরেমেও অনেক হিন্দু বেগম ছিল। যে বেগমদের নামের সাথে হয়ত হিন্দু শব্দ আছে।কিন্তু তাদের গর্ভ থেকে উৎপন্ন সন্তান সকলেই পিতার পরিচয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বী হয়েছে।

আজ শ্রী শব্দটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই। তারা বলে, শ্রী শব্দটি নিজের নামে সাথে স্বয়ং ব্যবহৃত হয় না। কথাটি প্রচলিত এবং জনপ্রিয় হলেও, কথাটি সঠিক নয়। আমরা যদি আমাদের বাঙালি মহাপুরুষদের দিকে তাকাই তবে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র সহ সকলের লেখালেখি এবং স্বাক্ষরে শ্রী শব্দটির উপস্থিতিটি কমন। তারা সকলেই তাদের নামের স্বাক্ষরে শ্রী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাই আমাদের সকলেরই নামের সাথে এই ভূখণ্ডের সর্বজনীন শ্বাশত পরিচয়ের চিহ্ন শ্রী শব্দটি ব্যবহার করা প্রয়োজন। এতে সকলেই সর্বদা শ্রীযুক্ত হবে। তাইতো সঞ্জয়ের মুখে বলা গীতার শেষ শ্লোকটিতেও শ্রী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ শেষ শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যময়, মাহাত্ম্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবহ। সর্বদা শ্রী, বিজয়, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি এবং ঐক্যবদ্ধতার অখণ্ডিত রাজনৈতিক নীতির আশ্রয়ে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতিধ্রুর্বা নীতির্মতির্মম।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৮.৭৮)

“যেখানেই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধনুর্ধারী রক্ষাকারী পার্থ থাকবে; সেখানেই সর্বদা শ্রী, বিজয়, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি এবং ঐক্যবদ্ধতার অখণ্ডিত রাজনৈতিক নীতি সর্বদাই বিরাজ করবে।”

বৈদিক শ্রী এবং লক্ষ্মী একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।তাই শ্রীসূক্তে অসংখ্যবার ‘লক্ষ্মী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদের একাধিক মন্ত্রে ‘শ্রী’ শব্দটির উল্লেখ আছে:

“সোমঃ শ্রীণন্তি পৃশ্নয়ঃ”(০১.৮৪.১১)
“শ্রীণন্তি মতিভিঃ স্ববির্দম্” (০৯.৮৪.০৫)
“শ্রীণন্তি বসূভির্ন নিক্তৈঃ” (০৯.৯৩.০৩)

প্রাচীন ভারতবর্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের আদিতে শ্রী শব্দটি যুক্ত থাকতে দেখা যায়। এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত নালন্দা মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় উভয় নামেই খ্যাত প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হলেও, পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে ধীরেধীরে খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছে যায়। সেই নালন্দা মহাবিহারের শীলমোহরে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রসঙ্গে লেখা রয়েছে:

“শ্রীনালন্দামহাবিহারস্য আর্যভিক্ষুসঙ্ঘস্য”

ঋতুচক্রে শীতকালে শ্রীপঞ্চমী নামে একটি তিথিই আছে, যে তিথিতে গৃহ সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দিনটিকে বসন্তপঞ্চমীও বলা হয়। শীতের তীব্রতা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি থেকে কমতে শুরু করে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে এসে অনেকটাই কমে গিয়ে, দেহে শ্রী বা সৌন্দর্য প্রকাশিত হতে থাকে। শ্রীপঞ্চমীতে গায়ে হলুদ মেখে স্নান করার বিধি।

লেখক: শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *