দেবতাকে অর্পিত মাংসই কী শুধুমাত্র বৈধ? - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • October 1, 2023
  • Last Update September 30, 2023 10:21 pm
  • kolkata

সাধন জীবনের জন্য মাংসাহার নয়; আবার সবাই সাধন জগতের অধিকারী নয়। সনাতন ধর্মে বৃথা হিংসা পশুবধ করে মাংস ভোজন নিষিদ্ধ। কিন্তু শাস্ত্রে দেবতাদের উদ্দেশ্যে সমর্পণ করে মাংস ভোজন করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহাভারতে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে যে যজ্ঞে বা দেবতাদের সমপর্ণ করে, তবেই মাংস ভোজ করতে।যবচূর্ণ বা যবনির্মিত পিঠা, খিচুড়ি, মাংস এবং বিবিধ প্রকারের পিঠা সহ সকল উপাদেয় সুস্বাদু খাবার কখনো একা খেতে নেই; দেবতাদের সমপর্ণ করে, সকলকে দিয়ে তবেই খেতে হয়।

সংযাবং কৃসরং মাংসং শঙ্কুলীং পায়সং তথা ।
আত্মার্থং ন প্রকৰ্ত্তব্যং দেবাৰ্থস্তু প্রকল্পয়েৎ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৪০)

“যবচূর্ণ বা যবনির্মিত পিঠা, কৃশর ( তিলতণ্ডুলকৃত সিদ্ধান্ন বা খিচুড়ি ), মাংস, শঙ্কূল( ঘিয়ে ভাজা ময়দার পিঠা) ও পায়স এগুলো নিজের জন্য প্রস্তুত করবে না; ঐ সমস্ত দ্রব্য দেবতার নিমিত্ত প্রস্তুত করবে।”

মহাভারতের এ নির্দেশনাটি মনুসংহিতার মধ্যেও পাওয়া যায়। সেখানে অসংস্কৃত পশুমাংস অর্থাৎ যে পশুকে যজ্ঞে দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পণ করা হয় নি, সেই পশুর মাংস ভোজন করতে নিষেধ করা হয়েছে।

বৃথাক্‌সরসংযাবং পায়সাকূপমেব চ ।
অনুপাকৃতমাংসানি দেবান্নানি হবীংষি চ ॥
(মনুসংহিতা:৫.৭)

“দেবতাকে না দিয়ে তিলতণ্ডুলকৃত সিদ্ধান্ন বা খিচুড়ি; ক্ষীর ও গুড়মিশ্রিত ঘিয়ে ভাজা গমচূর্ণ; দুগ্ধজাত বিবিধ প্রকারের পায়স; বিবিধ প্রকারের উপাদেয় সুস্বাদু পিঠা; অসংস্কৃত পশুমাংস অর্থাৎ যে পশুকে যজ্ঞে দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পণ করা হয় নি, সেই পশুর মাংস; পূজা বা হোমপূর্ব অন্ন, অর্থাৎ দেবতাকে নিবেদনের পূর্বে নৈবেদ্যাদি অন্ন ঘৃত বর্জনীয়।”

শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত বলিকৃত পশু সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তিলাভ করে। ষড়রিপুর নাশের প্রতীক হিসেবেই পশুবলি দেয়া হয়। যেমন পাঁঠা হলো অনিষ্টকর কামের প্রতীক, মহিষ হলো ক্রোধের প্রতীক। তবে পশুবলি হয়তো প্রতিকী। কিন্তু সত্যিকারের পশুবলি দেবতার উদ্দেশ্যে তখনই সার্থক হবে, যখন সত্যি সত্যি দেহ থেকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য রূপ শরীরস্থ এই ষড়রিপুকেই বিনাশ করতে পারবে। পশুত্ব থেকে প্রথমে মনুষ্যত্ব এবং অন্তে দেবত্বে পৌঁছতে হত। দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলিকে শাস্ত্রে অহিংসা বলা হয়েছে। দেবতা ও পিতৃলোকের উদ্দেশ্য পশুকে বলিরূপে সমর্পণ করে, অবশিষ্ট মাংস ভোজন করলে কোন প্রকারের দোষ আশ্রয় করে না।যজ্ঞ সিদ্ধির নিমিত্ত প্রজাপতি স্বয়ংই পশু সমুদর সৃষ্টি করেছেন।অতএব যজ্ঞে যে পশুবধ তাহা বধ নয়; এ দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য যজ্ঞ। তাই এতে কোন প্রকার পাপ হয় না।

যজ্ঞায় জন্ধির্মাংসস্যেত্যেষ দৈবো বিধিঃ স্মৃতঃ ।
অতোঽন্যথাপ্রবৃত্তিস্ত রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে ॥
ক্রীত্বা স্বয়ং বাপ্যুৎপাদ্য পরোপকৃতমেব বা।
দেবান্ পিতৃংশ্চার্চয়িত্বা খাদন্মাংসং ন দুষ্যতি ॥
(মনুসংহিতা:৫.৩১-৩২)

” যজ্ঞ করে মাংস ভোজন করবে, কারণ যজ্ঞের হুতাবশিষ্ট যে মাংস, সেই মাংসের ভোজনকে দৈব বিধি বলে। যজ্ঞ ব্যতিরেকে মাংসভোজনকে, অর্থাৎ নিজের জন্য পশু হত্যা করে মাংস ভোজনের প্রবৃত্তিকে রাক্ষস বিধি বলে ।
ক্রীত বা নিজে পশুপালন করে তার মাংস বা অপর কর্তৃক প্রদত্ত মাংস দেবগণ ও পিতৃগণকে অর্চনা করে ভক্ষণ করলে মনুষ্য দোষভাগী হয় না ।”

যজ্ঞার্থং পশবঃ সৃষ্টাঃ স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা।
যজ্ঞোঽস্য ভূত্যৈ সর্বস্য তস্মাদ যজ্ঞে বধোহবধঃ৷৷ (মনুসংহিতা:৫.৩৯)

“যজ্ঞের অঙ্গস্বরূপ যে পশুবধ তা সিদ্ধ করবার জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজেই পশুসমূহ সৃষ্টি করেছেন; আর যজ্ঞ এই সমগ্র জগতের ভূতি বা পুষ্টির সাধক। সেই কারণে যজ্ঞে যে পশুবধ তা বর্ধই নয়, কারণ, এইরকম ক্ষেত্রে পশুবধে পাপ নেই।”

মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে দেবোদ্দেশে বলিদানে যে হিংসা শাস্রে তাকে বৈধহিংসা বলা হয়েছে। বৈধহিংসায় পাপ স্পর্শ করে না। তাই দেবোদ্দেশে বলিদান উৎসর্গ ব্যতীত সর্বত্রই হিংসা বর্জন করতে হবে।

দেবোদ্দেশং বিনা ভদ্রে হিংসাং সর্বত্র বর্জয়েৎ।
কৃতায়াং বৈধহিংসায়াং নরঃ পাপৈর্ন লিপ্যতে।
( মহানির্বাণতন্ত্র:১১.১৪৩)

“ভদ্রে! দেবতার উদ্দেশ্য ব্যতিরেক কোন স্থলেই হিংসা করবে না। ফলত এই প্রকার দেবতার উদ্দেশ্যে বা শ্রাদ্ধকাল প্রভৃতিতে বৈধ হিংসা করলে, সে ব্যক্তি পাপে লিপ্ত হবে না।”

মাংস আহারের প্রতি মানুষের প্রবৃত্তি চিরকালের। এ কথাটি বেদে বলা হয়েছে। মদ্যাসক্ত আসক্ত ব্যক্তির নিকটে যেমন মদ্য প্রিয়, তারা শুধু মদ্যের সন্ধানে এবং অপেক্ষাতেই থাকে; মাংস প্রিয় মাংসাশী যেমন মাংসের অপেক্ষাতেই থাকে।

যথা মাংসং যথা সুরা যথাক্ষা অধিদেবনে।
যথা পুংসো বৃষণ্যত স্ত্রিয়াং নিহন্যতে মনঃ।
এবা তে অঘ্ন্যে মনোঽধি বৎসে নি হন্যতাম্ ॥ ১॥
(অথর্ববেদ সংহিতা: ৬ কাণ্ড,৭ অনুবাক,৯ সূক্ত.১)

“সুরাসক্তের নিকট সুরা প্রিয়, মাংসাশীর নিকট মাংস প্রিয়, দ্যূতকারের নিকট দ্যূতস্থান প্রিয়, সুরতাকামী পুরুষের মন স্ত্রীবিষয়ে আসক্ত হয়ে থাকে, সেই রকমই, হে অবধ্য গাভী! তোমার এই বৎস তোমার প্রিয় হোক।”

তাই কদাচিত কিছু মনুষ্য ছাড়া মাংস যেহেতু জগতের অধিকাংশ মানুষই ভোজন করে বা করতে চায়; তাই সুসংস্কৃত করে ভোজন করা উচিত। পশুকে যখন দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পণ করা হয় তখন সেই সংস্কৃত মাংস ভোজনে পাপ আশ্রয় করে না।বেদের পরে বৈষ্ণবদের প্রধান গ্রন্থ হলো শ্রীমদ্ভাগবত এবং বিষ্ণু পুরাণ। বৈষ্ণবদের জীবনে শ্রীমদ্ভাগবতের প্রভাব তীব্র এবং অসীম। পশুবলি এবং মাংসাহার সম্পর্কে “মাংসাশীর নিকট মাংস প্রিয়”, অথর্ববেদের এ নির্দেশনাই পাওয়া যায় শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে।

লোকে ব্যবায়ামিষমদ্যসেবা
নিত্যাস্তু জন্তোর্ন হি তত্র চোদনা।
ব্যবস্থিতিস্তেষু বিবাহযজ্ঞ
সুরাগ্রহৈরাসু নিবৃত্তিরিষ্টা॥

ধনং চ ধর্মৈকফলং যতো বৈ
জ্ঞানং সবিজ্ঞানমনুপ্রশান্তি।
গৃহেষু যুঞ্জতি কলেবরস্য
মৃত্যুং ন পশ্যন্তি দুরন্তবীর্যম্৷৷

যদ্ ঘ্রাণভক্ষো বিহিতঃ সুরায়া-
স্তথা পশোরালভনং ন হিংসা।
এবং ব্যবায়ঃ প্রজয়া ন রত্যা
ইমং বিশুদ্ধং ন বিদুঃ স্বধর্মম্৷৷

যে ত্বনেবংবিদোঽসন্তঃ স্তব্ধাঃ সদভিমানিনঃ।
পশূন্ দ্রুহ্যন্তি বিস্ৰব্ধাঃ প্ৰেত্য খাদন্তি তে চ তান্॥
(শ্রীমদ্ভাগবত:১১.৫.১১-১৪)

“বেদবিধিতে সেই সকল কর্মের নির্দেশ আছে যাতে মানব স্বাভাবিকভাবে আকৃষ্ট হয় না। জগতে দেখা যায় যে প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মৈথুন তথা মাংস এবং সুধা অভিমুখে ধাবিত হয়। অতএব বেদবাণীতে এই কর্মে যুক্ত হওয়ার বিধান দান কখনো সম্ভব নয়। এইরূপ পরিস্থিতিতে বিবাহ, যজ্ঞ, সৌতামণি যজ্ঞদ্বারা তার সেবনের যে বিধান বেদবাণীতে পরিলক্ষিত হয় তাঁর তাৎপর্য হল মানবকুলের উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও তাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা । শ্রুতির অভীষ্ট বা উদ্দেশ্যও হল সেই সকলথেকে দূরে রেখে মানবকুলের উদ্ধার সাধন৷

অর্থের যথার্থ প্রয়োগ হল ধর্ম পালনে ; কারণ ধর্ম থেকে পরমতত্ত্ব জ্ঞান এবং তার নিষ্ঠায় অপরোক্ষ অনুভূতি লাভ হয় এবং নিষ্ঠাতেই পরম শান্তির নিবাস। কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে মানব সেই অর্থের ব্যবহার গৃহস্থালি স্বার্থে অথবা কামভোগেই করে থাকে ; তারা ভুলে যায় যে তাদের দেহ মৃত্যুর অধীন এবং তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া কখনো সম্ভব হয় না৷

শ্রৌত্রামণি যজ্ঞেও সুরা আঘ্রাণের বিধান আছে পানের নয়। যজ্ঞে পশু উৎসর্গ পালনীয়, হিংসা নয়। এইভাবে সহধর্মিণীর সহিত মৈথুনের অনুমতি ধার্মিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নিমিত্ত সন্তান উৎপন্ন করবার জন্যই দেওয়া হয়েছে, বিষয়ভোগের উদ্দেশ্যে কখনো নয়। কিন্তু অর্থবাদের এই দিকগুলিতে অভ্যস্ত বিষয়ীগণ এই বিশুদ্ধ ধর্মকে মানে না।

বিশুদ্ধ ধর্মে জ্ঞানহীন অহংকারী ব্যক্তিগণ বস্তুত দুষ্ট হয়েও নিজেদের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে থাকে। সেই দেবতাকে সমর্পণ না করা বিপথগামী ব্যক্তিরা পশুদের উপরে বৃথা হিংসা করে। মৃত্যুর পর সেই পশুরাই সেই ঘাতকদের ভক্ষণ করে।”

যজ্ঞে পশু উৎসর্গ পালনীয়, হিংসা নয় এ বিষয়টি বোঝাতে শ্রীমদ্ভাগবতে ‘আলভন’ শব্দটির প্রয়োগ করা হয়েছে। আলভন শব্দটির [আ + √ লভ্ + অন ( ল্যুট্ )-ভা; নুম্-পক্ষে ‘আলম্ভন’, পা ৭.১.৬৪ ] প্রধানতম অর্থই হল হিংসা বা বধ। এছাড়া স্পর্শন ও মর্দন অর্থেও শব্দটি প্রযুক্ত হয়।শ্রীমদ্ভাগবতের একাদশ স্কন্ধে বলা হয়েছে, শাস্ত্রে দেবোদ্দেশে পশুবধের বিধান থাকলেও বৃথা হিংসার বিধান নেই।কিন্তু ভোগাসক্ত মানুষ এই বিশুদ্ধ ধর্ম জানে না। শাস্ত্রে অনভিজ্ঞ, গর্বিত ও পণ্ডিতম্মন্য সেই পাপাচারী নিঃশঙ্কচিত্তে পশুবধ করে, কিন্তু পরলোকে সেই নিহত পশুরাই ( বলি না দিয়ে হত্যা করা) তাদের মাংস খেয়ে থাকে। এইভাবে যারা পশুহিংসা দ্বারা পরদেহের প্রতি হিংসা করে, তারা সেই সর্বান্তর্যামী শ্রীহরিকেই দ্বেষ করে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে আরও বলা হয়েছে, মাংসের প্রতি যারা অত্যাধিক আসক্ত, তারা কেবলমাত্র শাস্ত্রনির্দিষ্ট কর্মের জন্য বনে গিয়ে প্রয়োজন মতো অনিষিদ্ধ প্রাণীকে বধ করতে পারেন। তবে শসস্ত্রে বৃথা প্রাণীহিংসা করতে বারেবারেই নিষেধ করা হয়েছে।প্রবৃত্তিমার্গকে নিয়ন্ত্রিত করে নিবৃত্তিমার্গে যেতে বলা হয়েছে।

তীর্থেষু প্রতিদৃষ্টেষু রাজা মেধ্যান্ পশূন্ বনে ।
যাবদর্থমলং লুব্ধো হন্যাদিতি নিয়ম্যতে ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত:৪.২৬.৬ )

“যার মাংসের প্রতি অত্যাধিক আসক্তি আছে, সেই রাজা কেবলমাত্র শাস্ত্রনির্দিষ্ট কর্মের জন্য বনে গিয়ে প্রয়োজন মতো অনিষিদ্ধ প্রাণীকে বধ করতে পারেন , বৃথা প্রাণীহিংসা কোনমতেই করবেন না- শাস্ত্রে এইভাবে নির্দেশ দিয়ে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।”

শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধে কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞ পশু ভিন্ন অন্য কোন প্রাণীকে বধ করতে নিষেধ করা হয়েছে।

তমৃত্বিজঃ শত্রুবধাভিসন্ধিতং
বিচক্ষ্য দুষ্প্রেক্ষ্যমসহ্যরংহসম্।
নিবারয়ামাসুরহো মহামতে
ন যুজ্যতেঽত্রান্যবধঃ প্ৰচোদিতাৎ ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত: ৪.১৯.২৭)

“ক্রোধাবেশে তাঁর মূর্তি তখন এমন ভয়াল রূপ ধারণ করল যে তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। ঋত্বিকগণ যখন দেখলেন যে অসহ্য পরাক্রমশালী মহারাজ পৃথু ইন্দ্রকে বধ করতে প্রস্তুত হয়েছেন, তখন তাঁরা তাঁকে নিবৃত্ত করতে প্রয়াসী হয়ে বলতে লাগলেন— ‘মহারাজ ! আপনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি, সুতরাং এ কথা আপনার অজ্ঞাত নয় যে যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ার পর কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞ পশু ভিন্ন অন্য কাউকে বধ করা উচিত নয়।”

পদ্মপুরাণের স্বর্গখণ্ডে বলা হয়েছে, আঁইশ যুক্ত মাছ এবং কৃষ্ণসার হরিণের মাংস দেবতা ও ব্রাহ্মণদের নিবেদন করে খেলে কোন পাপ আশ্রয় করে না।

মৎস্যান্ সশল্ক ন্ ভুঞ্জীঃ মাংসং রৌরবমেব চ।
নিবেদ্য দেবতাভ্যস্তু ব্রাহ্মণেভ্যশ্চ নান্যথা।।
(পদ্মপুরাণ: স্বর্গখণ্ড,২৮.৩৮)

” সশল্ক বা আঁইশ যুক্ত মাছ এবং রুরু মৃগ বা কৃষ্ণসার হরিণের মাংস দেবতা ও ব্রাহ্মণদের নিবেদন করে খেতে হয়, এ ব্যতিরেকে খাওয়া উচিত নয়।”

কূর্মপুরাণে বলা হয়েছে, শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত বা দৈবকর্মে নিযুক্ত হয়ে দেবতাকে সমর্পিত মাংস ভক্ষণ কর্তব্য। পক্ষান্তরে দেবতাকে সমর্পিত মাংস যে প্রত্যাখ্যান করে, সে ব্যক্তি যজ্ঞের সেই পশুর পশমের সমপরিমাণ বছর নরকভোগ করে।

আমন্ত্রিতস্তু যঃ শ্রাদ্ধে দৈবে বা মাংসমুৎসৃজেৎ।
যাবস্তি পশুরোমাণি তাবতো নরকান ব্রজেৎ।
(কূর্মপুরাণ: উপরিভাগ,১৭.৪২)

“যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত বা দৈবকর্মে নিযুক্ত হয়ে দেবতাকে সমর্পিত মাংস ভক্ষণ না করে প্রত্যাখ্যান করে, যজ্ঞের সেই পশুর যতগুলি লোম আছে, সেই ব্যক্তি তত বছর নরকভোগ করে।”

বিবিধ শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, পশুকে দেবতাকে সমর্পণ করে, দৈব বিধি অনুসারে সেই পশুর মাংস ভোজন করতে। দৈব বিধি অনুসরণ করলে তবেই মাংস সুসংস্কৃত হয়। দেবতাকে সমর্পণে পশুহত্যা পাপ হয় না। পক্ষান্তরে দেবতাকে সমর্পিত করে সুসংস্কৃত মাংস যদি ভোজন না করা হয়, তবে তা অশাস্ত্রীয় রাক্ষস বিধিতে পরিণত হয়, যা অত্যন্ত অধর্ম। রাক্ষস বিধিতে দেবতাকে সমর্পণ না করে শুধু ভোজনের উদ্দেশ্যে পশুকে হত্যা করা হয়। রাক্ষস বিধি অনুসরণ করলে পরকালে সেই পশুই ভক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে ভক্ষণ করে। ভৌগোলিক কারণে জগতের সকল অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই উদ্ভিজ্জ আমিষ ভোজী হওয়া দুষ্কর শুধু নয় অসম্ভবও বটে। মনুষ্যের মাংস ভোজনের প্রবৃত্তি সহজাত। মাংস ভোজনের আকাঙ্ক্ষা থাকবে। বিষয়টি অথর্ববেদেও বলা হয়েছে। যারা সাধন জীবনের উন্নতির জন্য উদ্ভিজ্জ আমিষ ভোজন করছে, তাদের কথা আলাদা। তাদের প্রাণীজ আমিষ ভোজন না করাই সর্বোত্তম পন্থা। সাধন জীবনের বাইরে যারা প্রতিনিয়ত প্রাণী হত্যা করে প্রাণীজ আমিষ ভোজন করছে, সেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উচিত মাংসকে কসাইয়ের দোকান থেকে না কিনে দেবতাকে সমর্পণ করে তবেই ভোজন করা। কলকাতার গোপাল মুখোপাধ্যায়ের মত কদাচিত কিছু ব্যক্তির ঝটকা পদ্ধতির দোকান বাদ দিয়ে বাকি বঙ্গদেশে মাংসের দোকানদারদের প্রায় সকলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। ঝটকা মাংসের দোকানে সৃষ্টিকর্তার নামে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য পশুটিকে হত্যা করে পরবর্তীতে দোকানে বিক্রি করে। সেই কসাইয়ের দোকানের মাংসের থেকে দেবতাকে সমর্পণ করে দৈব বিধি অনুসারে মাংস ভোজন করা উত্তম শুধু নয় সর্বোত্তম।

কৃতজ্ঞতা: কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *