'গো' শব্দের মুখ্য অর্থ রশ্মি - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • May 25, 2023
  • Last Update April 29, 2023 5:58 pm
  • kolkata

মহর্ষি যাস্কের নিরুক্তে ‘গো’ শব্দের প্রধানতম অর্থ করা হয়েছে, রশ্মি বা আলোক। ‘গো’ শব্দে সূর্য্যের সমস্ত রশ্মিকে বোঝায়।

সর্ব্বেঽপি রশ্ময়ো গাব উচ্যন্তে ৷৷
( নিরুক্ত: ২.১.৬.১২)
“সমস্ত রশ্মিই ‘গো’ বলে অভিহিত হয়।”

গো’ অর্থে শুধুই গরুকে বোঝায় না। সূর্যের কিরণকেও বোঝায়। বেদাঙ্গগ্রন্থ যাস্কের নিরুক্তেও বিষয়টি যেমন বলা আছে, তেমনি বেদানুগত মহাভারত সহ অন্যান্য গ্রন্থেও বলা হয়েছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে গোসকল পবিত্রতা, পুষ্টি ও দীপ্ত সূর্য কিরণের সমতুল্য।

প্রাপ্তা পুষ্ট্যা লোকসংরক্ষণেন
গাবস্তুল্যাঃ সূর্যপাদৈঃ পৃথিব্যাম্।
শব্দশ্চৈকঃ সন্ততিশ্চোপভোগাস্ত –
স্মাদ্ গোদঃ সূর্য্য ইবাবভাতি।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৫৮.৫৪)

“পৃথিবীতে গোসকল পবিত্রতা, পুষ্টি ও সূর্য কিরণের তুল্য হয়। ‘গো’ শব্দে ধেনু ও সূর্য কিরণ বোঝায়। গোদুগ্ধ উপভোগ করে সন্তান বেঁচে থাকে। তাই গোদাতা সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হয়।”

গোশব্দ পৃথিবীরই নামান্তর অর্থাৎ গোশব্দে পৃথিবীকে বুঝায়। কারণ, পৃথিবী দূরগতা অর্থাৎ যতদূরেই যাওয়া যায় পৃথিবীকেই পাওয়া যায়। এর অন্ত উপলব্ধি করা যায় না; আর এতে প্রাণিগণ গমনাগমন করে। ‘গম্’ ধাতুর উত্তর ডো প্রত্যয় করে ‘গো’ শব্দ নিষ্পন্ন। প্রত্যয় কর্তৃবাচ্যে বা অধিকরণবাচ্যে হয়েছে। গত্যর্থক ‘গা’ ধাতুর উত্তর কর্তৃবাচ্যে বা অধিকরণবাচ্যে ‘ও’ প্রত্যয় করেও ‘গো’ শব্দের নিষ্পত্তি হতে পারে। অর্থ হবে পূর্বসূত্রে যেমন বলা হয়েছে তেমন। এ প্রসঙ্গে স্কন্দস্বামী বলেন ‘গা’ ধাতু স্তুত্যর্থক। কাজেই ‘গা’ ধাতু হতে নিষ্পন্ন ‘গো’ শব্দের অর্থ হবে—যে স্তুত হয় অথবা যাতে অবস্থিত হয়ে স্তুতি করে। আবার ‘গো’ শব্দ লোকে এবং বেদে পশু বুঝাতেও প্রযুক্ত হয়। এই ‘গো’ শব্দও পূর্বোক্ত ধাতুদ্বয় হতেই অর্থাৎ ‘গম্’ বা ‘গা’ ধাতু হইতেই নিষ্পন্ন। এর অর্থ— ‘যে যায়’ (গচ্ছতীতি)। স্কন্দস্বামীর মতে ‘গা’ ধাতু স্ত্যত্যৰ্থক, কাজেই ‘গা’ ধাতু নিষ্পন্ন পশুবোধক ‘গো’ শব্দেরও ব্যুৎপত্তি হবে ‘গীয়তে তূয়তেঽসৌ’— যে স্তুত হয় অর্থাৎ লোকে যার গুণকীর্তন করে।

গৌরিতি পৃথিব্যা নামধেয়ং যদ্ দূরং গতা ভবতি যচ্চাস্যাং ভূতানি গচ্ছন্তি।।
গাতেবৌকারো নামকরণঃ ॥
অথাপি পশুনামেহ ভবভ্যেতস্মাদেব ॥

( নিরুক্ত: ২.১.৫.২-৪)

” গো শব্দটি পৃথিবীর নাম; যেহেতু পৃথিবী দুরগতা হয়, আর যেহেতু এতে প্রাণিগণ গমন করে।”

অথবা ‘গা’ ধাতু হতেও গো শব্দের নিষ্পত্তি করা যেতে পারে; প্রত্যয় হইবে ‘ও’।

এবং লোকে এবং বেদে ‘গো’ শব্দ পশুনামও হয়, অর্থাৎ পশুবোধকও বটে এই ধাতুদ্বয় ( ‘গম্’ ধাতু ও ‘গা’ ধাতু ) হতেই নিষ্পন্ন।”

আবার গো শব্দে মাধ্যমিকা বাক্ অর্থাৎ বিদ্যুৎকেও বোঝায়।

গৌর্ব্যাখ্যাতা।।
(নিরুক্ত: ১১.৪১.৩)
“গো শব্দ ব্যাখ্যাত হয়েছে।”

বৈদিক শাস্ত্রে গো শব্দটি সর্বদাই গাভী অর্থে ব্যবহৃত হবে না। যদি সর্বদাই গাভী অর্থে আমরা ব্যবহার করি, তবে বিভিন্ন স্থানেই শব্দটি ভিন্ন অর্থ প্রদান করবে। যেমন বৈদিক একজন প্রখ্যাত ঋষির নাম ‘গোতম’। এই ঋষির নামের গো শব্দে যদি আমরা গাভী অর্থে গ্রহণ করি, তবে এই ‘গোতম’ শব্দের অর্থ হয় গাভীতম। অর্থটি অনেকটা হাস্যকর। কোন বৈদিক ঋষির পিতা নিশ্চই তার সন্তানের নাম গাভীতম রাখবে না। কিন্তু অর্থটি যদি আমরা আলোক অর্থে গ্রহণ করি, তবে এই ‘গোতম’ শব্দের অর্থ সম্পূর্ণভাবে পালটে যায়। তখন এই গোতম শব্দের অর্থ হয় আলোকতম বা সর্বশ্রেষ্ঠ আলোকের দীপ্তি। এই প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায় অথর্ববেদের ব্রহ্মণের নাম ‘গোপথ ব্রাহ্মণ’। যদি এই ‘গোপথ ব্রাহ্মণ’ শব্দে আমরা গো অর্থে গাভীকে গ্রহণ করি। তবে এই ব্রাহ্মণ গ্রন্থটির অর্থ দ্বারায় গাভী বা গরুর পথের ব্রাহ্মণ। কিন্তু ‘গোপথ ব্রাহ্মণ’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো,(গোপথ) আলোকময় পথ এবং ‘ব্রাহ্মণ’ (ব্রহ্মকে যিনি নিজে জেনে অন্যকে জানিয়ে দেন)। অর্থাৎ শব্দটির অর্থ ব্রহ্মের আলোকময় অতীন্দ্রিয় পথ যিনি জানিয়ে দেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি অর্থ সম্পূর্ণভাবে পালটে যাচ্ছে। তাই বেদে গো শব্দটির ব্যবহার নিয়ে অজ্ঞানতাবশত যথেচ্ছাচার করা উচিত নয়। ‘গো’ শব্দটি যেমন আলোক অর্থে ব্যবহৃত, তেমনি পৃথিবী অর্থে ব্যবহৃত, ইন্দ্রিয় অর্থে ব্যবহৃত এবং সর্বোপরি গাভী অর্থে ব্যবহৃত। মন্ত্রে প্রয়োগ দেখে শব্দটির অর্থ গ্রহণ করতে হবে। আক্ষরিক অর্থে নয়। আমাদের আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বেদের অধিকাংশ মন্ত্রই আক্ষরিক অর্থে গ্রহণীয় নয়। এর আধ্যাত্মিক অর্থটিই প্রধানতম। তাই বেদের মধ্যেই বলা হয়েছে যে, দেবতারা পরোক্ষবাক পছন্দ করেন। তাই বেদমন্ত্রের সকল অর্থই আক্ষরিক অর্থে প্রযুক্ত হবে না।

তস্মাদিদন্দ্রো নাম, ইদন্দ্রো হ বৈ নাম।
তমিদন্দ্রং সন্তমিন্দ্র ইত‍্যাচক্ষতে পরোক্ষেণ,
পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ,
পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ।।
(ঐতরেয় উপনিষদ: ১.৩.১৪)

“যেহেতু পরমাত্মা জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজেকে অপরোক্ষ দর্শন করেছিলেন। তাই সেই পরমাত্মা ‘ইদন্দ্র’ নামে অভিহিত। তিনি ‘ইদন্দ্র’ নামে খ্যাত হলেও ব্রহ্মজ্ঞগণ তাঁকে পরোক্ষভাবে ‘ইন্দ্র’ নামে অভিহিত করেন। কারণ দেবগণ পরোক্ষপ্রিয়। অর্থাৎ দেবগণ পরোক্ষবাক্য পছন্দ করেন।”

সর্বক্ষেত্রে ‘গো’ শব্দটির গরু অর্থ করে প্রতিদিন অনেক অনর্থ করে যাচ্ছি এবং বেদ সম্পর্কিত প্রচুর ভুল ধারণা জন্ম দিয়ে চলছি প্রতিনিয়ত।

“রহস্যবিদ্যা গোপন রাখতেই হবে, অতএব প্রতীক ও প্রতীকাত্মক শব্দের সহায়তা অনিবার্য। অর্থ-গুপ্তির নিমিত্ত ছদ্মাবরণের (মুখোস) প্রয়োজনে ঋষিরা দ্ব্যর্থ-বোধক শব্দের আশ্রয় নিলেন। এ-কৌশলটি অতিশয় সুগম সংস্কৃত ভাষায় কারণ একই পদের নানা ভিন্নার্থ-সম্ভাব্যতা এই ভাষার বৈশিষ্ট্য,—যে কারণে ইংরাজী ভাষায় অনুবাদ অত্যন্ত দুরূহ এবং স্থানে স্থানে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলা চলে। যেমন, পশু-সংজ্ঞক ‘গো’ শব্দের আর এক অর্থ ‘আলোক’ বা ‘আলোক-রশ্মি’, ‘প্রকাশ-রশ্মি’। এই অর্থে পদ টির প্রয়োগ দৃষ্ট হয় কতিপয় ঋষির নামকরণে, যথা ‘গোতম’ অর্থাৎ উজ্জ্বলতম, ‘গবিষ্ঠির’ অর্থাৎ আলোক-আকাশে স্থির জ্যোতি। বৈদিক ‘গো-বৃন্দ’ শব্দটি গ্রীসদেশের পৌরাণিক গাথার পরিচিত সত্য-জ্যোতি-জ্ঞান সূর্যের রশ্মি অর্থে প্রযুক্ত, ‘গো-যূথ’ শব্দের সম-পর্যায়ী। কতকগুলি সূক্ত থেকে সঙ্কলিত এই অর্থ সর্বত্র ব্যবহাত হলে কোথাও অর্থবোধে অসঙ্গতি পাওয়া যায় না। প্রচলিত অর্থে, ‘ঘৃত’-শব্দটিতে বুঝায় পরিশোধিত নবনীত জাত আজ্য-পদার্থ, যজ্ঞীয় কর্মে মুখ্য বিশেষাঙ্গ উপাদানগুলির অন্যতম।”
(শ্রীঅরবিন্দ, ২০০৭: ১২)

বেদ মন্ত্রেও বলা যে, দেবতারা পরোক্ষ বাক পছন্দ করেন। তাই বেদও পরোক্ষবাকে রচিত। সেই বেদমন্ত্রের মধ্যে যদি কেউ গো শব্দটি অনুবাদের ক্ষেত্রে সর্বদা গাভী অর্থে গ্রহণ করতে গিয়ে অর্থের অনর্থ করছেন। বলছেন বেদের মধ্যে গোমাংস খাওয়ার কথা আছে। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় একটু সাধারণ দৃষ্টিতে চিন্তা করলেই পাওয়া যায় যে, যে বেদের মধ্যে গোহত্যাকারী পাপীকে সীসার গুলিবিদ্ধ করতে বলা হয়েছে, সেই বেদমন্ত্রে কি করে গোহত্যার কথা থাকবে? সমস্যাটা বেদমন্ত্রের নয়, আমাদের অজ্ঞানতাপ্রসূত বোঝার ভুল। বৈদিক পরম্পরাগত ধারাবাহিক জ্ঞানের অভাবে এই ভুলগুলোর প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। যার নিরসন অত্যাবশকীয়।

তথ্য সহায়তা:
১. অমরেশ্বর ঠাকুর, ‘নিরুক্তম্’, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা: পুনঃ সংস্করণ, ২০০৫
২.শ্রীঅরবিন্দ, বেদরহস্য (পূর্বার্দ্ধ), শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পুদুচেরি: ষষ্ঠ মুদ্রণ, ২০০৭

লেখক: শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *