চয়ন মুখার্জি:
-” তুমি কি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছো মা?”
– সরল সাধাসিধে কিন্ত আভিজাত্যপূর্ণ ভদ্রমহিলার উত্তরে বধূটি নীরব থাকে।
– “বলো মা, কোনো ভয় নেই। তুমি কি নিজের ইচ্ছায় এসেছ নাকি জোর করে আনা হয়েছে? তোমার বাবা মা ভাই বোন , এরা কোথায়?”
বধূটি নিরুত্তর। তার হয়ে জবাব দেয় পাশের পুরুষটি –
‘ বিবিজান আমার বড় লাজুক। সদ্য নিকাহ হৈচে মেমসাহেব, অচেনা লোকের লগে কথা কয় না!”
পাশের ইংরেজ পুলিশ অফিসারটিও কনভিন্সড। কিন্তু ততক্ষণে ভদ্রমহিলার একটু সন্দেহ হয়েছে
– ” অফিসার, আই ওয়ান্ট ট্যু ইন্টারোগেট দিস লেডি প্রাইভেটলি। প্লিজ এরেঞ্জ!”
-” হোয়াই মিস?শি ইজ হিজ লিগ্যাল ওয়াইফ। দ্য এনটায়ার পিকচার ইজ কোয়াইট ক্লিয়ার য়্যান্ড …”
কথা শেষ করতে না দিয়ে ভদ্রমহিলা আবার গর্জে উঠলেন-
-” অফিসার , আই সেড, আই ওয়ান্ট ট্যু ইন্টারোগেট প্রাইভেটলি। প্লিজ এরেঞ্জ!”
ব্যবস্থা হলো । আর পুরুষটি চোখের আড়াল হতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো বধূটি।
“আমারে বাঁচান দিদিমণি। আমার বাপরে ভাইরে মাইরা জোর কইরা তুইলা আনসে। মা – রেও কুথায় পাঠাইসে জানি না। মুখ খুললে গুম কইরা দিবে কয়।”
কান্নার শব্দ শুনে ছুটে এলেন ইন্সপেক্টর। যারপরনাই অপ্রস্তুত এই ভদ্রমহিলার বিচক্ষণতা দেখে
“হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর স্যার?”- আবার মহিলার গর্জন -” টেক হার উইথ আস!”
-“ইয়েস ম্যাডাম!”
****
” দিদিমণি, ওরা ফতোয়া দিসে!”
– “চিঠিটা দিয়ে এসেছিস?”
-“হ”
– ” ঠিক আছে যা। “
তবু অনুগত ভৃত্যটি সরে না। যে খবর সে শুনে এসেছে…
“কীরে, দাঁড়িয়ে কেন?”
“দিদিমণি ..”
” আচ্ছা কী বলবি বল? কী ফতোয়া?”
-” সারোয়ার ফতোয়া দিসে, তুমার …তুমার ..”
-” জানি। আমার ইজ্জত নিলে দশ হাজার টাকা দেবে, এই তো?!”
-” দিদিমণি..!”
“ভয় পাস না। তোর দিদিমণির ইজ্জত কেউ নিতে পারবে না রে! এই দ্যাখ, এটা সবসময় নিয়ে ঘুরছি!”
-হাতের কাছে থাকা একটি কৌটো খুলে দেখালেন ভদ্রমহিলা। অনুগত ভৃত্য দেখলো, তার মধ্যে রাখা, বিষ!
*****
একাকী বীরকে ঘিরে শত্রুর দল, এমনটা বললে আপনাদের কার কথা মনে আসে? নিশ্চয়ই অভিমন্যুর!
এবার ভাবুন, কোনো এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তার মধ্যে গিজগিজ করছে নররূপী হায়নার দল, লক্ষ্য নারীমাংস।
তারই মধ্যে জীবন বিপন্ন করে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক বাঙ্গালী মহিলা। লক্ষ্য একটাই, যতগুলি সম্ভব ধর্ষিতা , অপহৃতা মেয়েকে উদ্ধার করতে হবে। প্রাণ যায় যাক, সম্মান তুচ্ছ, ওই হতভাগ্য মেয়েগুলোকে উদ্ধার করতেই হবে!
নোয়াখালি, ১৯৪৬। বাঙ্গালী ভদ্রমহিলার নাম সুচেতা কৃপালিনী।
***
জন্ম ১৯০৮ সালের ২৫ শে জুন, এক বাঙ্গালী ব্রাহ্ম পরিবারে। বাবা এস এন মজুমদার ছিলেন সরকারি ডাক্তার, সেই সূত্রে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ট্রান্সফার ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তাই ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরতে হয়েছে সুচেতাকে।
নিজের আত্মজীবনীতে নিজেই লিখেছেন যে ছোটবেলায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক। তবে মাঝে মাঝেই সেই শান্তসত্বার মধ্যে থাকা তেজ বেরিয়ে পড়তো।
লাহোরে কলেজে পড়াকালীন, যে শিক্ষক বাইবেল শেখাতেন, তিনি হঠাৎই হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু কটূক্তি করলেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি এসে বাবার কাছে সব খুলে বললেন তরুণী সুচেতা। শাস্ত্রের কিছু তত্ত্ব জেনে পরের দিন আবার সেই শিক্ষকের ক্লাসে আগের প্রসঙ্গ উঠতেই একের পর এক যুক্তির জালে শিক্ষককে চুপ করিয়া দিলেন তিনি।
এরপর থেকে ওই শিক্ষক আর হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু বলার সাহস পাননি।
পড়াশোনা শেষ করে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পদ গ্রহণ করলেন। সেখানেই পরিচয় হলো জে বি কৃপালিনীর সঙ্গে, তারপরে ১৯৩৬ সালে ২৮ বছর বয়সী সুচেতা , তাঁর চেয়ে ২০ বছরের বড় জে বি কৃপালিনীকে বিয়ে করে হলেন সুচেতা কৃপালিনী। বয়সের এত ব্যবধান থাকা সত্বেও, রাজনীতি বা সংসার, চিরকাল হাতে হাত রেখে চলেছেন, আবার মতের অমিল হলে মুখের ওপর স্বামীকে বলে দিতে ছাড়েননি।
