"ওরে আলোর পথ যাত্রী.." - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • September 20, 2023
  • Last Update August 27, 2023 11:21 am
  • kolkata

চয়ন মুখার্জি: 

-” তুমি কি নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছো মা?”

– সরল সাধাসিধে কিন্ত আভিজাত্যপূর্ণ ভদ্রমহিলার উত্তরে বধূটি নীরব থাকে।

– “বলো মা, কোনো ভয় নেই। তুমি কি নিজের ইচ্ছায় এসেছ নাকি জোর করে আনা হয়েছে? তোমার বাবা মা ভাই বোন , এরা কোথায়?”

বধূটি নিরুত্তর। তার হয়ে জবাব দেয় পাশের পুরুষটি –

‘ বিবিজান আমার বড় লাজুক। সদ্য নিকাহ হৈচে মেমসাহেব, অচেনা লোকের লগে কথা কয় না!”

পাশের ইংরেজ পুলিশ অফিসারটিও কনভিন্সড। কিন্তু ততক্ষণে ভদ্রমহিলার একটু সন্দেহ হয়েছে

– ” অফিসার, আই ওয়ান্ট ট্যু ইন্টারোগেট দিস লেডি প্রাইভেটলি। প্লিজ এরেঞ্জ!”

-” হোয়াই মিস?শি ইজ হিজ লিগ্যাল ওয়াইফ। দ্য এনটায়ার পিকচার ইজ কোয়াইট ক্লিয়ার য়্যান্ড …”

কথা শেষ করতে না দিয়ে ভদ্রমহিলা আবার গর্জে উঠলেন-

-” অফিসার , আই সেড, আই ওয়ান্ট ট্যু ইন্টারোগেট প্রাইভেটলি। প্লিজ এরেঞ্জ!”

ব্যবস্থা হলো । আর পুরুষটি চোখের আড়াল হতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলো বধূটি।

“আমারে বাঁচান দিদিমণি। আমার বাপরে ভাইরে মাইরা জোর কইরা তুইলা আনসে। মা – রেও কুথায় পাঠাইসে জানি না। মুখ খুললে গুম কইরা দিবে কয়।”

কান্নার শব্দ শুনে ছুটে এলেন ইন্সপেক্টর। যারপরনাই অপ্রস্তুত এই ভদ্রমহিলার বিচক্ষণতা দেখে

“হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর স্যার?”- আবার মহিলার গর্জন -” টেক হার উইথ আস!”

-“ইয়েস ম্যাডাম!”

****

” দিদিমণি, ওরা ফতোয়া দিসে!”

– “চিঠিটা দিয়ে এসেছিস?”

-“হ”

– ” ঠিক আছে যা। “

তবু অনুগত ভৃত্যটি সরে না। যে খবর সে শুনে এসেছে…

“কীরে, দাঁড়িয়ে কেন?”

“দিদিমণি ..”

” আচ্ছা কী বলবি বল? কী ফতোয়া?”

-” সারোয়ার ফতোয়া দিসে, তুমার …তুমার ..”

-” জানি। আমার ইজ্জত নিলে দশ হাজার টাকা দেবে, এই তো?!”

-” দিদিমণি..!”

“ভয় পাস না। তোর দিদিমণির ইজ্জত কেউ নিতে পারবে না রে! এই দ্যাখ, এটা সবসময় নিয়ে ঘুরছি!”

-হাতের কাছে থাকা একটি কৌটো খুলে দেখালেন ভদ্রমহিলা। অনুগত ভৃত্য দেখলো, তার মধ্যে রাখা, বিষ!

*****

একাকী বীরকে ঘিরে শত্রুর দল, এমনটা বললে আপনাদের কার কথা মনে আসে? নিশ্চয়ই অভিমন্যুর!

এবার ভাবুন, কোনো এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তার মধ্যে গিজগিজ করছে নররূপী হায়নার দল, লক্ষ্য নারীমাংস।

তারই মধ্যে জীবন বিপন্ন করে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক বাঙ্গালী মহিলা। লক্ষ্য একটাই, যতগুলি সম্ভব ধর্ষিতা , অপহৃতা মেয়েকে উদ্ধার করতে হবে। প্রাণ যায় যাক, সম্মান তুচ্ছ, ওই হতভাগ্য মেয়েগুলোকে উদ্ধার করতেই হবে!

নোয়াখালি, ১৯৪৬। বাঙ্গালী ভদ্রমহিলার নাম সুচেতা কৃপালিনী।

***

জন্ম ১৯০৮ সালের ২৫ শে জুন, এক বাঙ্গালী ব্রাহ্ম পরিবারে। বাবা এস এন মজুমদার ছিলেন সরকারি ডাক্তার, সেই সূত্রে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ট্রান্সফার ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তাই ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরতে হয়েছে সুচেতাকে।

নিজের আত্মজীবনীতে নিজেই লিখেছেন যে ছোটবেলায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক। তবে মাঝে মাঝেই সেই শান্তসত্বার মধ্যে থাকা তেজ বেরিয়ে পড়তো।

লাহোরে কলেজে পড়াকালীন, যে শিক্ষক বাইবেল শেখাতেন, তিনি হঠাৎই হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু কটূক্তি করলেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি এসে বাবার কাছে সব খুলে বললেন তরুণী সুচেতা। শাস্ত্রের কিছু তত্ত্ব জেনে পরের দিন আবার সেই শিক্ষকের ক্লাসে আগের প্রসঙ্গ উঠতেই একের পর এক যুক্তির জালে শিক্ষককে চুপ করিয়া দিলেন তিনি।

এরপর থেকে ওই শিক্ষক আর হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু বলার সাহস পাননি।

পড়াশোনা শেষ করে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পদ গ্রহণ করলেন। সেখানেই পরিচয় হলো জে বি কৃপালিনীর সঙ্গে, তারপরে ১৯৩৬ সালে ২৮ বছর বয়সী সুচেতা , তাঁর চেয়ে ২০ বছরের বড় জে বি কৃপালিনীকে বিয়ে করে হলেন সুচেতা কৃপালিনী। বয়সের এত ব্যবধান থাকা সত্বেও, রাজনীতি বা সংসার, চিরকাল হাতে হাত রেখে চলেছেন, আবার মতের অমিল হলে মুখের ওপর স্বামীকে বলে দিতে ছাড়েননি।

ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে বন্দেমাতরম গান গাইছেন সুচেতা কৃপালিনী।

এল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। অরুণা আসফ আলী উষা মেহতার সঙ্গে সুচেতাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই বিপ্লবযজ্ঞে।কর্মদক্ষতা দেখে মুগ্ধ হলেন গান্ধী, কস্তুরবা গান্ধীর নামাঙ্কিত ট্রাস্টের দায়িত্ব অর্পণ করলেন তাঁর হাতে। সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সূচনা যাদের হাতে, তাদের একজন সুচেতা।

মেয়েরা রাজনীতিতে এগিয়ে আসুক, না হলে তাদের বক্তব্য প্রাধান্য পাবে না, এমনটাই মনে করতেন তিনি। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি,

“Thousands of women have participated in the various struggles of the Congress, but women had not been properly organised so far, and there was no woman’s organisation, parallel to, or as part of, the Congress’s organisation …..had to go from state to state, meet the Provincial Congress Committee leaders, meet all the women workers, and set up little women’s units in each state,”

এল কলঙ্কিত ১৯৪৬। প্রথমে কলকাতায় ডাইরেক্ট একশন ডে। সেখানে সুবিধা করতে না পারায় , তারপরে মুসলিম লীগের গোলাম সারোয়ারের নেতৃত্বে ১৮% হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াখালীতে শুরু হলো হিন্দু নিধন যজ্ঞ। হাজারে হাজারে ধর্ষণ, কত মহিলা অপহৃতা হলেন তার ইয়ত্তা নেই! বাঙ্গালার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী নির্বিকার থাকলেন ,হিন্দুরা বুঝলো শেয়ালের কাছে মুরগিছানা জমা রাখা হয়েছে!”

স্থির থাকতে পারলেন না সুচেতা। গান্ধীর সঙ্গে পা দিলেন নোয়াখালীর মাটিতে, তারপরেই শুরু হলো তার মিশন। হতভাগ্য মেয়েগুলোকে বাঁচাতে হবে। সঙ্গী ছিলেন আরো সব নমস্য মহিলা বিপ্লবী, বীণা দাস (ভৌমিক) , লীলা রায় (নাগ),শান্তিলতা প্রমুখ!

রেগে অগ্নিশর্মা গোলাম সারওয়ার ফতোয়া জারি করেছিল, যে সুচেতাকে ধর্ষণ করতে পারবে ,তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। একটুও ভীত না হয়ে সুচেতা হাজার হাজার নেকড়ের মাঝে সেই অভিযান চালাতে লাগলেন।

ঠিক কত মহিলাকে সেদিন উদ্ধার করেছিলেন সুচেতারা?

প্রায় দেড় হাজার!

পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা আছে!!!

না , এরপরেও নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তার নাম মনোনীত হয়নি! অবশ্য সুচেতারা কবেই বা তার পরোয়া করেছেন!

১৯৪৬ সালেই আইনসভায় নির্বাচিত হলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট মধ্যরাতে নেহরুর ভাষণের আগে আইনসভায় তিনি “বন্দেমাতরম”গানটি নিজে গেয়েছিলেন।

স্বাধীন ভারতে ,প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে তাঁর স্বামী জে বি কৃপালিনীর মনান্তর ঘটলো, স্বামী প্রতিষ্ঠা করলেন, কৃষক মজদুর প্রজা পার্টি। সেই পার্টিতে যোগদান করলেন তিনি এবং সেই পার্টির টিকিটেই কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে ১৯৫১ সালের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে জিতলেন তিনি। তাঁর পাঁচ বছর পরে , ১৯৫৭ সালে আবার জয়, এবার অবশ্য পুরনো দল কংগ্রস থেকেই!

তারপরে ১৯৬৩ সালে আবার জীবনে মোড় ঘুরলো। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীত্ব নিতে হলো তাকে, হলেন ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। সেই যুগে, অভাবনীয় ব্যাপার!

দক্ষ প্রশাসক হিসাবে নিজের শাসনকালে পরিচিত ছিলেন তিনি, ১৯৬৭ সাল অব্দি দৃঢ়তার সঙ্গে রাজ্য শাসন করেছেন। সরকারি কর্মচারীরা তার আমলে ৬২ দিন ধরে ধর্মঘট চালালেও তিনি অবিচল ছিলেন, ইউনিয়ন নমনীয় হওয়ার পরেই তিনি আলোচনায় বসতে রাজী হয়েছিলেন।

আমরা কথায় কথায় লৌহমানবী মার্গারেট থ্যাচারের উদাহরণ দিই। আমাদের দেশেও এরা থাকেন।শুধু আমরা স্বীকৃতি জানাতে পারি না।

রাজনীতি থেকে অবসর ১৯৭১ সালে।আত্মজীবনী রচনা করলেন, নাম “An Unfinished Autobiography”

জীবনদীপ নির্বাপিত হলো ১ লা ডিসেম্বর, ১৯৭৪।

আজ ২৫ শে জুন, জন্মবার্ষিকীতে এই মহিয়সী নারীর উদ্দেশ্যে প্রণাম।

আক্ষেপের বিষয় এই যে নোয়াখালীর হিন্দু মহিলা ধর্ষণকে জাস্টিফাই করেছিলেন যিনি সেই সোহরাওয়ার্দী বিবিসির সেরা ২০ বাঙ্গালীর তালিকায় আছেন, অথচ সেই নোয়াখালী জেনোসাইডে হাজারের বেশি অপহৃতা মহিলাকে উদ্ধার করা সুচেতা কৃপালিনী ও তাঁর সঙ্গীদের স্থান নেই সেখানে।

স্রেফ বাঙ্গালায় কথা বলতে জানলেই কী আর বাঙ্গালী হওয়া যায়!!

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *