Home - ইতিহাস - সতীপীঠ কন্যাশ্রম এক স্বনির্বাসিত পীঠস্থান।
৫১ সতীপীঠ, এই শব্দগুলোর মধ্যেই যেন আছে রোমাঞ্চ আর রহস্য।
সত্যযুগে নারায়ণের সুদর্শন চক্রাঘাতে খণ্ডিত সতীর দেহ ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে৷ সতীর পৃষ্ঠদেশ যেইস্থানে পড়ে, সেই স্থানটির শাস্ত্রীয় নাম কন্যাশ্রম। এখানে দেবী হলেন সর্বাণী, আর ভৈরব নিমিষ।
স্থানটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কারো মতে স্থানটি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী, কারো মতে কন্যাকুব্জে৷ কিন্তু বেশিরভাগ পন্ডিতের মতে এই শক্তিপীঠ বাংলাদেশের কুমারীকুণ্ডে অবস্থিত। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে কাব্যে এ বিষয়ে কিছু পাওয়া যায় না। শিবচরিত শাস্ত্র মতে বৈবস্বতের দেশে দেবীর পৃষ্ঠদেশ পতিত হয়। জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস তাঁর অভিধানে শিবচরিতের মত মেনে নিয়ে বলেছেন বৈবস্বত শব্দের অর্থ সূর্য তনয়। সূর্য যেহেতু পূর্ব দিকে উদিত হয়, তাই ভারতবর্ষের পূর্বে অবস্থিত বাংলাদেশেই এই পীঠের অবস্থান হবে। সতীপীঠ গবেষক ডঃ দীনেশ চন্দ্র সরকারের মতে সীতাকুণ্ডের কুমারীকুণ্ডই কন্যাশ্রম শক্তিপীঠ। বারাহী তন্ত্রে উল্লেখ আছে চন্দ্রনাথ মন্দিরের পঞ্চক্রোশ দূরত্বের মধ্যেই কুমারীকুণ্ড শক্তিপীঠ অবস্থিত। বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর বৃহৎ তন্ত্রসার গ্রন্থে কুমারীকুণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন এই পীঠস্থান তান্ত্রিক দীক্ষা লাভের উপযুক্ত স্থান। বর্তমানে এর অবস্থান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সীতাকুণ্ড উপজেলার বড় কুমিরার গহীন অরণ্যে।
প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি অবশ্য বর্তমানে দেখতে পাওয়া যায় না। যাত্রা শুরু হয় গোল্ডেন ব্রিক কারখানার পাশের খাল ধরে। খালের আঁকাবাঁকা পথ ধরে অনেকটা হাঁটতে হয়৷ প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে হাঁটতে গিয়ে পায়ের তলে কখনো মাখনের মত নরম কাদা, কখনো ভুরভুরে বালি, কখনো চোখা চোখা পাথর, কখনো পিচ্ছিল পলি দলে দলে এগোতে হয়।
অবশেষে ভেতরে গেলে প্রথম বিস্ময়, ডানদিকে পাহাড়ের গায়ে একটি অগ্নিকুণ্ড চোখে পড়ে৷ ছোট বৃত্তাকার কুণ্ডে জলের ওপর জ্বলছে আগুন। তার স্পর্শে নিম্নগামী ঝরণার জলও উষ্ণ। সেটি অতিক্রম করে বাঁকানো পথ ধরে বামে ঘুরে গেলে কুমিরা খালের সরু একটি শাখা আমাপ সরে গেছে। সেখানে গুহাপথের মতো রাস্তা ধরে গেলে হঠাৎ ঘোলাজলের মাঝে দেখা যায় স্বচ্ছ জলের ধারা। সেটির উৎস ধরে এগোলেই কুমারীকুণ্ড।
দ্বিতীয় বিস্ময় এই কুণ্ড। চারপাশের ঘোলা জলের মাঝে কুণ্ডের জল ঈষৎ নীলাভ ও স্বচ্ছ। সেখানে উঠছে তিনটি বুদবুদের সারি। তার পাড় ইট দিয়ে বাঁধানো। আর একদিকে ধ্বংস স্তুপে মিশে যাওয়া চুন সুরকিতে গাঁথা পুরু দেয়াল। খুব বেশিদিন হয়নি মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। গোষ্ঠবিহারী ধর রচিত সচিত্র তীর্থ-ভ্রমণ-কাহিনী গ্রন্থেও কুমারীকুণ্ড মন্দিরের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে ঠিক কি কারণে মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে তা নিয়ে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয় না। স্থানীয় কারো মতে, কুমারীকুণ্ড মন্দিরের প্রতিমা চুরি হবার পর মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকে মন্দিরের অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ নিয়ে কেবল এই কুণ্ডটিই অবশিষ্ট আছে। দুর্গম পথ হওয়ায় ভক্তদের দেখাও তেমন পাওয়া যায় না। অভিমানী মা যেন কত অভিমানে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে আছেন তথাকথিত সভ্য জগৎ থেকে।
পীঠাধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বাণী হলেন মূলদুর্গার অনুরূপ। ধ্যানমন্ত্রানুসারে তিনি সিংহবাহিনী, তাঁর কপালে অর্ধচন্দ্র, তাঁর অঙ্গবর্ণ মরকত মণির মতো সবুজ৷ তিনি ত্রিনয়নী, তাঁর চার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ শোভা পায়। মুক্তা মাণিক্য শোভিত অলংকারে তিনি সুশোভিতা। তিনি দুর্গতিহারিণী দুর্গা৷ আর দেবূট ভৈরব নিমিষ হলেন পঞ্চবক্ত্র, নীলকণ্ঠ, প্রতিটি মুখই ত্রিনেত্রযুক্ত। গলায় মুণ্ডমালা, চার হাতে খড়গ, ত্রিশূল, কপাল ও অক্ষমালা যুক্ত, ললাটে অর্ধচন্দ্র। নিতান্তই বন্য পরিবেশ বলে নিত্যপূজার কোন ব্যবস্থা নেই। পূজা করতে চাইলে নিজেদেরই সব দেখে নিতে হবে। 📸: শ্রীশারদ চৌধুরী ও শ্রীঅর্পণ মিত্র। ✍️: শ্রীচয়ন দাশ।