অস্তাচলে তপন, বঙ্গের হিন্দু হৃদয়সম্রাট - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • October 2, 2023
  • Last Update October 1, 2023 9:34 am
  • kolkata

“মেডিকেল হসপিটালের ডাক্তার নার্সরা প্রচুর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে ঠাকুরের ইচ্ছা মা কালীর ইচ্ছা অন্যরকম। তাই আমি এখন স্বামী বিবেকানন্দ , ডাক্তারজী (আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা), গুরুজী (আর এস এস এর দ্বিতীয় সঙ্ঘ চালক), শ্রী কে. এন. গোবিন্দ আচার্য এবং আমার মা ও বাবার আশীর্বাদ নিয়ে পৃথিবীর থেকে বিদায় নিতে চাই। কোন মৃত্যুভয় নেই। বার বার আসবো এই ভারত মায়ের কােলে ফিরে। ভারত মাতা কি জয়!”

কথাগুলো ০৪.০৭.২০২০, শনিবার হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে যাবার শেষ মুহূর্তে ২:১৭ মিনিটে বলেছিলেন হিন্দু সংহতির প্রতিষ্ঠাতা, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের রূপকার, বঙ্গের হিন্দু হৃদয়সম্রাট শ্রদ্ধেয় শ্রীতপন ঘোষ দাদা।তিনি হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন তিনি ভেন্টিলেশন থেকে আর ফিরে আসবেন না; তাই আদর্শিক শিষ্য রাজা দেবনাথকে ফোন করে কথাগুলো বলেছিলেন এবং রাজা দেবনাথ তার মোবাইলে কথাগুলো রেকর্ডিং করে।মৃত্যুসজ্জায় এমন নির্ভীকচিত্তে জীবনকে স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করে পুনরায় মাতৃভূমিতে জন্ম নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা; একমাত্র দৃঢ়হৃদয় নির্ভীক চিত্তের মানবের পক্ষেই সম্ভব। সাধারণ মানুষ যা ভাবতেও পারবে না।

তপন ঘোষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সালা থানার অন্তর্গত দক্ষিণখণ্ড নামক একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে জন্মগ্রহণ করেন। প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও, গ্রামটি ছিলো একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। ছোট্ট বয়স থেকেই তপন ঘোষ লেখাপড়ার পাশাপাশি পারিবারিক ভাবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে। ঠাকুরদার কাছে রামায়ণ, মহাভারত সহ বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ আদর্শিক চরিত্রের সম্পর্কে তিনি বাল্যকালেই জানতে পারেন। প্রায় পাঁচ বছর বয়সেই রামায়ণ মহাভারতের অনেক কাহিনী আত্মস্থ হয়ে যায়। এই শুদ্ধ, মানবিক এবং বিরত্বের কাহিনী উত্তরকালে তাঁর উপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বাল্যকাল থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ধর্মীয় আচার পালন করতেন। পরবর্তীতে তিনি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের থেকে স্বধর্ম রক্ষায় বেশি মনোযোগী হন। বাল্যকালে তিনি নিজেই মাটির প্রতিমা তৈরি করে পূজা করতেন। যথাসম্ভব ধ্যান করতেন। ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার এক তীব্রতর প্রচেষ্টা তাঁর বাল্যকাল থেকেই ছিলো।

ভারতবর্ষে রাষ্ট্রবাদী জাতীয়তাবাদী চিন্তা বর্তমানে হিন্দুত্ববাদী আদর্শ নামে পরিচিত। এই রাষ্ট্রবাদী জাতীয়তাবাদী চিন্তা নিয়ে যারা রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রধানতম। পরিবর্তিতে তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলায় সে রকম নেতৃত্ব তৈরি হয়নি বললেই চলে। সবাই ঘষেমেঝে যার যার সাধ্যানুসারে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেউ বিষয়টিকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের অধিকার বিষয়ে কেউ নিজস্ব ব্যক্তিগত প্রভায় যদি সবাইকে আলোড়িত করতে পারেন, তিনি হলেন শ্রীতপন ঘোষ। অসম্ভব সাহস, জেদ, একাগ্রতা এবং বুদ্ধিদীপ্ততা ছিল তাঁর মাঝে।এমন জ্ঞান, বুদ্ধিদীপ্ততা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সর্বোপরি সবাইকে আদর্শিক বিষয়গুলো বোঝানোর ক্ষমতা ভাগবান জগতের খুব কম মানুষকেই দিয়েছে। তিনি নিজে নির্ভীক হয়ে হিন্দুদের নির্ভীক চিত্তের হওয়ার প্রচারণা করেছেন আমৃত্যু। তিনি হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে সকল প্রকারের প্রচলিত অশাস্ত্রীয় সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বললেন হিন্দু সমাজের এই অশাস্ত্রীয় সামাজিক বিভাজনের ছিদ্র দিয়েই যুগেযুগে যোগেন মণ্ডলদের জন্ম হবে। এই যোগেন মণ্ডলরা নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে হিন্দু বিরোধী বৈদেশিক শক্তির ফাঁদে পা দিয়ে স্বজাতির সর্বোচ্চ ক্ষতি করবে। পরবর্তীতে হয়ত বুঝতে পারলেও তাদের আর কিছুই করার থাকবে না। তিনি আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন, সমাজে প্রচলিত সকল প্রকারের সামাজিক ব্যবধান দূর করার। ছোটকাল থেকেই তিনি সকলের সাথে প্রাণভরে মিলেমিশে বড় হয়েছেন। সমস্ত মানুষকেই তিনি আপন করে নিতে পেরেছিলেন। নিজেকে কখনও কোন ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেননি। পরিচিত হোক অথবা অপরিচিত হোক তাতে কিছুই যায় আসে না; সকলের দুঃখই তাঁকে বিচলিত করতো। এভাবেই তিনি সকলের বড় আপনজন হয়ে গিয়েছিলেন।

হিন্দুত্ববাদকে ভারতে রাষ্ট্রবাদী আদর্শও বলা হয়। আগামীতে হয়ত এ রাষ্ট্রবাদী দর্শনকে সামনে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রী হবে, মুখ্যমন্ত্রী হবে সব হবে; কিন্তু একজন সাহসী অকুতোভয় তপন ঘোষ আর হবে না। তিনি ছিলেন বাংলার বালা সাহেব ঠাকরে। নিস্তেজ বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি জোশ নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর অসংখ্য বক্তব্য এবং লেখালেখিতে তিনি বিষয়টি খোলাখুলিভাবে বলেছেন। তিনি বাঙালিকে শিখিয়েছিলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাতে বলেছিলেন, তেমনি তিনিও পশ্চিমবঙ্গের আত্মকেন্দ্রিক সাথেপাছে না থেকে শুধু নিজেরা সুবিধা নিয়ে নেয়া তথাকথিত সেকুলারদের একটা রাষ্ট্রবাদী চেতনার আঙ্গিকে একটা জুতসই জবাব দিতে পেরেছিলেন।হিন্দুদের অধিকার আদায়ের জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,’হিন্দু সংহতি’ নামে একটি অরাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগঠন। সংগঠনটিতে তাঁর আদর্শ প্রতিফলিত। নিজ সংগঠন সম্পর্কে তপনদা ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে বলেন:

“অন্য সংগঠনের সাথে সঙ্গে হিন্দু সংহতির তফাৎ কোথায় জানেন? হিন্দু সংহতি হিন্দুর প্রত্যেকটি সমস্যা সোজাসুজি টেক আপ করে, এবং সেগুলি নিয়ে লড়াই করে সমাধানের চেষ্টা করে। শুধু উপদেশ বা জ্ঞান দেয় না। না, একটু ভুল হল। প্রত্যেকটি সমস্যা নয়। যে সমস্যাগুলি আমাদের আয়ত্বের মধ্যে বলে মনে হয় শুধু সেই সমস্যাগুলি আমরা টেক আপ করি। বাকিগুলো করি না। কারণ হিন্দু সংহতি প্রতিবাদ করার জন্য তৈরী হয় নি। প্রতিকার করার জন্য তৈরী হয়েছে।এই মুহূর্তে তিনটি লাভ জেহাদের কেস আমাদেরকে ডীল করতে হচ্ছে। একটি মেয়ে জলপাইগুড়ির, একটি মেয়ে হাওড়ার ডোমজুর এর এবং একটি মেয়ে নন্দীগ্রামের। ২ টি নাবালিকা ও একটি সাবালিকা। কাজ এগোচ্ছে।”

শ্রী তপন ঘোষ।

সংগঠনটি জয়ধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করেন, ‘জয় মা কালী’। সকল প্রোগ্রামে স্টেজে মাকালীর ছবি থাকত। তপনদা বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির সাথে মাকালীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সারা ভারতে যেখানেই বাঙালি, সেখানেই কালীমন্দির। বাঙালির রাষ্ট্রবাদী বা হিন্দুত্ববাদী চিন্তায় বাঙালির নিজস্বতা থাকতেই হবে। কোন উত্তর, পশ্চিম বা দক্ষিণ ভারত থেকে আমদানি করা তত্ত্বে নয়। বাঙালির হিন্দুত্ববাদী চেতনায় থাকবে- শ্রীচৈতন্য, স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্বামী প্রণবানন্দ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু প্রমুখ। তবেই এ তত্ত্ব সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌছবে।

ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, সেখানে প্রতি জনগণনায় হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হিন্দুদের অধিকারের জন্যে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিষয়গুলো ভাববার এবং যুগপৎ চিন্তার। আজকে ১০/ ১২ বছর হবে তপনদার সাথে আমার পরিচয়। ছোটভাইয়ের মত দেখতেন আমাকে।অসংখ্য বিষয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে, যে স্মৃতিগুলো আজও জড়িয়ে আছে আমার মনে। ২০১৭ সালে জুন মাসে, আমাকে বললেন, “চলেন প্রফেসর বাবু আমরা কি করি দেখবেন।” আমিও আর না বলে দাদার সাথে তাঁর গাড়িতে বেড়িয়ে পড়লাম।নিউটাউন থেকে সামনে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে একটা গ্রামের মত এলাকাতে পৌছালাম। দেখলাম সেখানে কিছু হিন্দু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। সম্ভবত বাগদি হবে। ওখানে পৌছে আমি বিস্মিত হলাম, ২০ বছরের নিচে একটি বিবাহিত মেয়ে; দাদাকে দেখেই প্রণাম করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। পরে জানতে পারলাম, মেয়েটার স্বামী দাওয়াতি গ্রুপের পাল্লায় পড়ে মুসলিম হয়ে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এখানেও এ দাওয়াতি ধর্মান্তরিত করার গ্রুপ আছে?” পরে আমি তাদের থেকে বিস্তারিত যে সকল তথ্য পেলাম, তাতে আমার গা চমকে উঠলো। বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের মত একই দাওয়াতি গ্রুপ ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ গরিব হিন্দুকে প্রতিনিয়ত ধর্মান্তরিত করে চলছে। তাদের কথায় বুঝলাম, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনার স্থান কাল পাত্র হয়ত আলাদা, কিন্তু ফলাফলটা একই। অর্থাৎ ধর্মান্তরকারীদের চেতনাটা একই।

দাদার সাথে ১৯ জুন, ২০১৭ সালেই সম্ভবত আমার শেষ দেখা হয়, সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে কয়েকটি সংকীর্ণ গলির মধ্য দিয়ে দাদার ভুবন ধর লেনের বাসাতে যাই। দেখলাম এত বৃষ্টির মধ্যেও অনেকেই উপস্থিত। দাদা তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছেন। আমার ভেজা কাপড়চোপড় দেখে আমাকে বারবার তাঁর একটি ফতুয়া পড়তে অনুরোধ করলেন। প্রথমে সংকোচ বোধ করলেও, পরে আমি তাঁর দেয়া পেস্ট রংয়ের একটি ফতুয়া পড়ে আমার কাপড়চোপড়গুলো বাতাসে শুকাতে দেই। দাদা ছিলেন গণমানুষের নেতা, তাই প্রত্যেকরই ছিল তাঁর বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। অথচ বর্তমানে যারা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রবাদী রাজনীতির ধারক বাহক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়; তাদের সাথে তাদের নেতাকর্মীদের শুধু দাপ্তরিক বা সাংগঠনিক সম্পর্ক। নেতার বাড়িতে এক কাপ চা খাওয়ার সৌভাগ্য অধিকাংশ কর্মীরই হয় না। আদর্শকে গভীর ভাবে গ্রহণ করে যদি ব্যক্তিগত জীবনে তার প্রয়োগ না হয়, তবে আদর্শ শুধু একটা মুখোশের মতই উপরে উপরেই থাকে। আমি ব্যক্তিগত জীবনে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বড় বড় হিন্দুনেতাদের দেখেছি, তারা যখন বাংলাদেশে এসেছে আমরা যথাসাধ্য তাদের সম্মানিত করে আপ্যায়িত করেছি। কিন্তু কোলকাতায় গিয়ে যখন এই মানুষদের সাথে যোগাযোগ করেছি, তখন এমনও দেখেছি আমি উঠেছি হয়ত বাগুইআটি আমার দিদির বাসায়; এর আশেপাশেই অনেক নেতা থাকেন, এরপরেও তাদের সাথে দেখা করার জন্যে আমার কলেজস্ট্রিট, যাদবপুর, বেহালা এই দূরদূর এলাকাতে যেতে হয়েছে। কারণ সেখানে তাদের অফিস, তাদের সাথে কথা বলতে হলে তাদের অফিসে বসেই কথা বলতে হবে। ভাগ্যে থাকলে হয়ত এককাপ চা জুটবে। অবশ্য হিন্দিভাষী অঞ্চলের রাষ্ট্রবাদী চেতনার নেতাকর্মীদের দেখেছি পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের থেকে অনেকটাই আলাদা। ভাষাগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, তাদের আন্তরিকতা বলে শেষ করার মত না।

পশ্চিমবঙ্গের ফর্মাল রাষ্ট্রবাদী নেতাদের থেকে তপনদা ছিলেন একেবারে সম্পূর্ণ উল্টো। বিপদে পড়া অনেককেই তিনি তাঁর বাড়িতেই আশ্রয় দিতেন। সেখানে এত মানুষ আশ্রয় পেয়েছিল যে, আশ্রয় পাওয়া মানুষদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসের মত বাংলা সাহিত্যের একটা বড় উপন্যাস লেখা যায়। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা চমকে ওঠার মত জীবনের গল্প। সংগঠনকে অধিকাংশ নেতাই অফিস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। যদি বাড়ি পর্যন্ত কেউ আসেও, তাহলে সর্বোচ্চ ড্রইংরুম পর্যন্ত। ভেতরের ঘর পর্যন্ত তারা কখনই ঢুকতে পারে না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়,সংগঠনের নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের স্পন্দিত করতে পারে না। সেদিন বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ সহ বৈশ্বিক হিন্দুদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার তপনদার সাথে অসংখ্য কথা হয়। আমি অধিকাংশ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করলেও, কিছু বিষয়ে মতদ্বৈধতা জানিয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত জানাই। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর, সাহস এবং অভিজ্ঞতা আমাকে বিমুগ্ধ করে। তাঁর সাথে কথা বলে আমি যখন দিদির বাসার দিকে আসছি, তখনই পথেই দেখলাম তিনি আমার সাথে কিছুক্ষণ আগেই তোলা ছবিটি দিয়ে আমাকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন :

“সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের (SVS) সভাপতি, কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী আজ আমার বাড়ি এসেছেন। বাংলাদেশের হিন্দুদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক আলোচনা হল। এদের কাজকর্ম অনেকদিন ধরেই আমি লক্ষ্য রাখছি। যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী কাজ। সত্যিই প্রশংসনীয়। এই কাজের আরো উন্নতি হোক এটা আমার আন্তরিক কামনা। এই সংগঠনের সকল কর্মী ও সদস্যদের শুভেচ্ছা জানাই।”

পোস্টটি দেখে আমি একটু বিস্মিত হলাম, যে আমাকে নিয়ে তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। বিষয়টিতে আমার অন্যরকম এক ভাললাগার সাথে সাথে কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করলো। বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বড় সুহৃদ ছিলেন তিনি। তিনি সেদিন বলেছিলেন, “দেখুন আমরা এখান থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মাঝেমধ্যে হয়ত একটি দু’টি মানববন্ধন বা প্রতিবাদ কর্মসূচি করতে পারি ; কিন্তু অস্থিত্ব রক্ষার কাজটি আপনাদেরই করতে হবে। দেশকে ভালবেশে দেশপ্রেমকে সামনে নিয়ে নির্ভীকচিত্তে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে।” দাদার দৃঢ় কথাগুলো এখনো কানে বাজে। একবার এক ব্যক্তি তপন ঘোষ দাদাকে প্রশ্ন করে, “ভীতু ও যুদ্ধ বিমুখ বাঙালি জাতি কি লড়তে পারবে?” এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন:

“বাঙালি কখনোই যুদ্ধ বিমুখ জাতি নয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি ভীতু, লোভী, অলস, স্বার্থকেন্দ্রিক ও কেরিয়ারিস্ট। কিন্তু বাঙালি বলতে শুধু তাদেরকেই বোঝায় না।বাগদী, ডোম, হাড়ী, কাওড়া, বাল্মীকি, কৈবর্ত, গোয়ালা ঘোষ, নমশূদ্র, মাহাতো, চাঁই মণ্ডল, সাঁওতাল, রাজবংশী, অন্যান্য আদিবাসী, প্রভৃতি জাতি (caste) প্রচণ্ড সাহসী। তাদেরকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে তাদের হাতে সামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে তুলে দিলেই পুরো চিত্রটা বদলে যাবে, পাল্টে যাবে।”

আমাদের শাস্ত্রে আছে, মানুষের নাম ব্যক্তির উপরে প্রভাব বিস্তার করে। তাই সন্তানের নামটি ভেবেচিন্তে প্রাসঙ্গিকভাবে রাখতে হয়।তপনদার নামটিও তেমনি স্বার্থক, তিনি সত্যিই একটি জাজ্জ্বল্যমান সূর্য ছিলেন, তাঁর প্রভায় অনেক চন্দ্ররাই আজ রাতের অন্ধকার দূর করে আলোকিত করছে। তপনদাকে দেখে এবং তাঁর সম্পর্কে যত জানছি, ততই আমার গরুড় পুরাণে প্রাসঙ্গিক একটি শ্লোকের কথা মনে হয়:

নাভিষেকো ন সংস্কারঃ সিংহস্য ক্রিয়তে বনে।
নিত্যমূজ্জিতসত্ত্বস্য স্বয়মেব মৃগেন্দ্রতা।।
(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়,১৫)

“সিংহ বনে বাস করে। বনে তাকে কোন আনুষ্ঠানিক অভিষেক বা সংস্কার না করলেও সে তার আপন শক্তিবলেই বনের রাজায় পরিণত হয়।”

সত্যিই বঙ্গের সিংহ ছিলেন তপনদা। তাঁর ব্যক্তিত্ব হাবভাবে সিংহের তেজস্বীতা প্রকাশ পেত। কোন মেনি মেনি ভাব ছিল না, যা বলতেন অকুতোভয় নির্ভয়ে বলতেন। তিনি একটি চুম্বুকের মত ছিলেন, সবাই আকর্ষিত হত তাঁর এ সিংহদীপ্ত ব্যক্তিত্বে। আততায়ীদের উদ্দেশ্যে তাঁর হুঙ্কার আমাদের একজনও প্রেরণাপ্রদীপ্ত করে। তিনি বলেছিলেন:

“যতক্ষণ তোমরা মানুষ, আমরাও মানুষ। যখন তোমরা জানোয়ার হবে, আমরা হব ক্ষুধার্ত শিকারী।”

একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েও তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে হিন্দু সংস্কৃতির গৌরব প্রসঙ্গে নির্ভীকচিত্তে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, রাজনীতির অলগলিতে বদ্ধ না থেকেও নিজের ধর্মসংস্কৃতি রক্ষা করা যায়, প্রচার করা যায়। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই বিষয়টি বুঝতে পারেনি, তাঁকে ভুল বুঝেছে, নিন্দা করেছে, কুৎসা রটিয়েছে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আজ তারাই লজ্জায় মুখ ঢাকছে, বিবেক দংশন করছে তাদের। আমার জীবনে ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী অনেক মানুষকেই দেখেছি ; কিন্তু কোনদিন সমগ্র বাংলায় দ্বিতীয় কোন নির্ভীকচিত্তের তপন ঘোষের সাক্ষাৎ হবে কিনা, আমি ঠিক জানি না। দাদা আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনি আমাদের হৃদয়ে চিরঞ্জীবী হয়ে থাকবেন।এতদ্রুত আপনার পুণ্যস্মৃতি তর্পণ করতে হবে, তা আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি; এরপরেও গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মত আপনার স্মৃতিতর্পণ করলাম।

লেখা: শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *