“কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা,
দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা।
আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগী তাহার মলাট
দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট।
মায়ের ঘরের চৌকাঠেতে বারান্দার এক কোণে
দিন-ফুরানো ক্ষীণ আলোতে পড়েছি এক মনে।
অনেক কথা হয়নি তখন বোঝা,
যেটুকু তার বুঝেছিলাম মোট কথাটা সোজাঃ—
ভালোমন্দে লড়াই অনিঃশেষ,
প্রকাগু তার ভালবাসা, প্রচণ্ড তার দ্বেষ।
বিপরীতের মল্লযুদ্ধ ইতিহাসের রূপ
সামনে এল, রইনু বসে চুপ।”
দীনেশ চন্দ্র সেনের লেখা ‘রামায়ণী কথা’র শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব সুন্দরভাবে বলেছেন:
“রামায়ণ-মহাভারত শুধুমাত্র একটি মহাকাব্যই নয়, এটি একটি ইতিহাসও; ঘটনাপঞ্জির ইতিহাস নয়, কারণ এই ইতিহাস বারবার এবং সময়ের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন । রামায়ণ-মহাভারত ভারতের চিরন্তন ইতিহাস। অন্যান্য ইতিহাস অনেক বদলে গেছে সময়ের সাথে , কিন্তু এই ইতিহাস বদলায়নি। ভারতবর্ষের সমস্ত সাধনার ইতিহাস, সমস্ত আরাধনা, সমস্ত সংকল্প এই দুই মহাকাব্যিক ধর্মের মধ্যে চিরস্থায়ী সিংহাসনে নিহিত রয়েছে।”
আমরা যদি রামায়ণের কালের ইতিহাস খুঁজি তবে
রঘুবংশমে দেখি রঘু ও কৈবর্ত্যে রাজাদের মধ্যে যুদ্ধের উল্লেখ আছে। রঘু দিগ্বিজয়ের আবির্ভাব ঘটে এবং পূর্বের তালবন সমন্বিত সমুদ্র সৈকতে অবতরণ করেন। সেখানে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে
সুম্ভ ও বঙ্গের রাজাদের নৌবাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করেছিলেন।
বিজয়ের পর তিনি কপিসা( কংসাবতী) নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করেন এবং কলিঙ্গের (উড়িষ্যা)উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
“পৌরস্ত্যানেবমাক্রামংস্তাংস্তান্ জনপদান্ জয়ী।
প্রাপ তালীবনশ্যামমুপকণ্ঠং মহোদধেঃ ॥ ৩৪
অনম্ৰাণাং সমুদ্ধর্তুস্তস্মাৎ সিন্ধুরয়াদিব।
আত্মা সংরক্ষিত: সুহ্মৈর্বৃত্তিমাশ্ৰিত্য বৈতসীম্ ॥ ৩৫
বঙ্গানুৎখায় তরসা নেতা নৌ-সাধনোদ্যতান্ ।
নিচঘান জয়স্তম্ভান্ গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু সঃ ॥ ৩৬ ॥ আপাদপদ্মপ্রণতাঃ কলমা ইব তে রঘুম্ ।
ফলৈ: সংবর্দ্ধয়ামাসুরুৎখাত-প্রতিরোপিতাঃ ॥ ৩৭ ॥
স তীর্ত্বা কপিশাং সৈন্যৈর্বদ্ধদ্বিরদ-সেতুভিঃ। উৎকলাদর্শিত-পথঃ কলিঙ্গাভিমুখো যযৌ॥ ৩৮ ॥
সেই সময় বাংলা ও সুম্ভের উপর প্রবল পরাক্রমশালী কৈবর্ত রাজারা রাজত্ব করতেন। রামায়ণে বিভিন্ন সময়ে কৈবর্ত নৌশক্তির প্রশংসা করা হয়েছে -
“নাবাং শতানাং পঞ্চানাং কৈবৰ্ত্তানাং শতং শতম্। সন্নদ্ধানাং তথা যুনাস্তিষ্ঠান্ত্বিতভ্য চোদয়ৎ ॥”
রামায়ণ, দ্বিতীয়কাণ্ড ৮৪ সর্গ।
শ্লোকগুলি চিত্রিত করে যে নাব্য দেশের কৈবর্ত্য নৌবাহিনী কতটা শক্তিশালী ছিল।
যাবদাবর্ততে চক্রং তাবতী বসুন্ধরা।।
দ্রাবিড়াঃ সিন্ধুসৌবীরাঃ সৌরাষ্ট্রা দক্ষিণাপথাঃ। বঙ্গাঙ্গমগধা মৎস্যাঃ সমৃদ্ধাঃ কাশিকোসলাঃ।।
তত্ৰ জাতং বহু দ্রব্যং ধনধান্যমজাবিকম্।
ততো বৃণীষ্ব কৈকেয়ি যদ্ যত্ ত্বং মনসেচ্ছসি।। (রামায়ণ: অযোধ্যা, ১০.৩৬-৩৮)
সম্ভবত রঘুর সময় থেকে শ্রী রামচন্দ্রের পিতা রাজা দশরথের সময় পর্যন্ত বঙ্গদেশ তার সাম্রাজ্যে ছিল। রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ড অনুসারে, রাজা দশরথ কৈকেয়ীর সাথে কথোপকথনে বঙ্গকে একটি সমৃদ্ধ এবং ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
বাল্মীকি রামায়ণের তিনটি প্রধান সংস্করণ রয়েছে, একটি হল উদীচ্য রামায়ণ, অন্যটি হল দ্রাবিড় রামায়ণ এবং তৃতীয়টি হল গৌড়ীয় রামায়ণ৷ শুধুমাত্র গৌড়ীয় রামায়ণে লোকনাথের মনোরমা টিকা পাওয়া যায়৷
গৌড়ীয় রামায়ণ এবং উদীচ্য এবং দ্রাবিড় রামায়ণের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমত এই রামায়ণে,আদিকান্ডে, অযোধ্যা কাণ্ডে ও সুন্দরকাণ্ডে সর্গের সংখ্যা বেশি কিন্তু যুদ্ধকাণ্ডে সর্গের সংখ্যা কম।
দ্বিতীয়ত, সেই রামায়ণের গল্পে গৌড়ের জীবনযাত্রার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় রচিত মোট ২৫ টা রামায়ণ পাওয়া গেছে যা সমগ্র ভারতে সর্বোচ্চ। এমনকি হিন্দিতেও মাত্র ১১টি রামায়ণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও, অদ্ভূত রামায়ণের শাক্ত প্রভাব দেখে অনেকেই মনে করেন এটি একজন বাঙালির লেখা।
যদিও বাংলায় গৌড়ীয় রামায়ণের বয়স সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। টিকাটি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত যুগে বা শশাঙ্কের রাজত্বকালে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এটি লক্ষণীয় যে এই গৌড়ীয় রামায়ণটি প্রথম ভারত থেকে ইউরোপে পাঠানো হয়েছিল। বইটি দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮২৯-৩৬ সালে জার্মানিতে প্রকাশ হয়।
রামচরিত খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে দেবপালের সময় গৌড় অভিনন্দ লিখেছিলেন এবং পাল যুগে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে মুরারি মিশ্র অনর্গ রাঘব নামে একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এটি বিশ্বাস করা হয় যে নাটকটি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে মঞ্চস্থ করার জন্য রচনা করা হয়েছিল। এতে রামায়ণের বালকাণ্ড থেকে যুধ্যাকাণ্ড পর্যন্ত সমস্ত কিছু রয়েছে। পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে রামপালের সময়ে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ বিশেষভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। প্রসন্ন রাঘবও খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব লিখেছিলেন। তিনি ‘পীযূষবর্ষ’ উপাধি পেয়েছিলেন।
বাংলার পাল শাসনামলের একজন খ্যাতিমান কবি হলেন সন্ধ্যাকর নন্দী । তিনি আনুমানিক একাদশ শতাব্দীতে ‘রামচরিতম্’ নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেন। সন্ধ্যাকর নন্দী উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমিতে পুন্ড্রবর্ধন নগরের নিকটস্থ বৃহদ্বটু গ্রামে এক কায়স্থ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন পালরাজ রামপালের একজন মন্ত্রী (সান্ধিবিগ্রহিক)। সন্ধ্যাকর নিজে রাজা মদনপালের (আনু. ১১৪৩-১১৬২) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।সংস্কৃত ভাষায় রচিত এটি একটি দ্ব্যর্থবোধক কাব্য। অর্থাৎ প্রত্যেকটি শ্লোকের দুটি করে অর্থ প্রদান করে। চারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এ কাব্যে একই সঙ্গে দশরথপুত্র রামচন্দ্রের এবং গৌড়েশ্বর রামপালের চরিতকথা বর্ণিত হয়েছে। কাহিনীটি রামপালের বরেন্দ্র বিজয়ের সাথে রামের লঙ্কা বিজয়ের তুলনা করে লেখা হয়েছে।
মধ্যযুগের বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য নিদর্শন হলো মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের জীবনী, শ্রীরাম পাঁচালী। গ্রন্থটি লিখেছেন কৃত্তিবাস ওঝা। তাঁর সময়কাল হলো আনুমানিক ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দ।
খুব সম্ভবত এই রামায়ণ লেখা হয় মহারাজা গণেশ অথবা দেব সাম্রাজ্যের অধিপতি দনুজ মর্দন রামনাথ দেবের অনুগ্রহে।
রামায়ণ শুধু বঙ্গে নয় সারা ভারববর্ষের লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্যঅঙ্গ। ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি জাতি তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুসারে রামায়ণকে গ্রহণ করেছে। যেমন বাংলায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়লে মনে হবে, শ্রীরামচন্দ্র বুঝি বাঙালি ছিলেন। কৃত্তিবাস যখন রামায়ণ লিখেছেন, তখন বাঙালি সংস্কৃতির উপরে রামকে প্রতিস্থাপন করেছেন। তাই তো কৃত্তিবাসী রামায়ণ আজও প্রত্যকটি ঘরে ঘরে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামকে ‘ঘন দুর্বাদল শ্যাম’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বাংলায় রাম সম্ভবত এই রামায়ণ মহারাজা গণেশ বা দেবরাজ্যের শাসক দনুজ মর্দন রামনাথ দেবের অনুগ্রহে রচিত হয়েছিল। কৃত্তিবাসের রামায়ণে রামকে ‘ঘন দুর্বাদল শ্যাম’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় তাই রামের গায়ের রং সবুজ।
নরাঢ়বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি – “কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী”। মধ্যযুগে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের ভাবানুবাদ পালাগানের রূপে রচনা করেছেন। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরী রামায়ণ উল্লেখযোগ্য।
কবিচন্দ্রের দৌহিত্র বংশজাত শ্রী মাখনলাল মুখোপাধ্যায় কবিচন্দ্রের একটি গ্রন্থের সম্পাদনা করেন ১৩৪১ সালে। ভগবতামৃত শ্রী শ্রী গোবিন্দমঙ্গল নামের এই গ্রন্থের ভূমিকায় বিষ্ণুপুরী রামায়ণ কথাটা বাংলা সাহিত্যে প্রথমবার লিপিবদ্ধ হয়। এর আগে এই শব্দ লোকমুখে বহুল প্রচলিত ছিল।
তাঁর রচনায় ‘রামলীলা’, ‘রামমঙ্গল’ শব্দগুলি বহুল ব্যবহৃত। অধ্যাপক মণীন্দ্র মোহন বসুর কথায়, “কবিচন্দ্রের গ্রন্থ বিষ্ণুপুর অঞ্চলে গীত ও পঠিত হইত, এজন্য ইহা বিষ্ণুপুরী রামায়ণ নামেও প্রসিদ্ধ হইয়াছিল” (*)। এই প্রসঙ্গে ডঃ সুকুমার সেনের বক্তব্য, “কবিচন্দ্রের অধ্যাত্ম রামায়ণ নিবন্ধটি দক্ষিণ রাঢ়ে ‘বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’ নামে একদা প্রসিদ্ধ হইয়াছিল”(**)। ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “কবি যে নিষ্ঠা সহকারে কোনও বিশেষ সংস্কৃত কাব্যের অনুবাদ করেন নাই তাহা তিনি নিজেই স্বীকার করিয়াছেন। বাল্মীকি রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ, নিজস্ব কল্পনা প্রভৃতি মিশাইয়া কবি এই মিশ্র ধরণের রামকাব্য লিখিয়াছেন” (***)।
ডক্টর অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “কবি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি ভক্তি সহকারে কোনো বিশেষ সংস্কৃত কবিতা অনুবাদ করেননি। বাল্মীকি রামায়ণ, আধ্যাত্ম রামায়ণ, নিজের কল্পনা প্রভৃতি মিশ্রিত করে কবি এই মিশ্র রামকাব্য রচনা করেছেন”।
মল্ল রাজাদের উৎসাহে বিষ্ণুপুর ও মেদিনীপুর এলাকায় অসংখ্য রাম মন্দির নির্মিত হয়। রাবণ কাটা নৃত্য এখনও বিষ্ণুপুর এলাকায় জনপ্রিয়।
ষোড়শ শতকের সুবিখ্যার বাঙালি অদ্বৈত বৈদান্তিক সন্ন্যাসী মধুসূদন সরস্বতী অকপট ভাবেই ভগবান বিষ্ণু এবং তাঁর অবতার শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণকে জ্ঞেয় পরমতত্ত্বরূপে স্বীকার করেছেন। তাঁর শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকাগ্রন্থের নাম ‘গূঢ়ার্থদীপিকা’। এ গূঢ়ার্থদীপিকা গ্রন্থটি বাঙালির রচিত প্রথম শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকাগ্রন্থ। এ গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ শ্লোকেই তিনি ভগবান শ্রীনারায়ণ এবং তাঁর অবতার শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা করেছেন। ভক্তজনের মানস যাঁর নিবাসস্থল, সেই ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে তিনি নমস্কার করেছেন। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র যে বহুপূর্ব থেকেই বঙ্গের পণ্ডিতসহ সকলের আরাধ্যদেবতা ছিলেন; মধুসূদন সরস্বতীর শ্রীমদ্ভগবদগীতার গূঢ়ার্থদীপিকা টীকাগ্রন্থের শুরুতে শ্রীরামচন্দ্রের বন্দনা এর বড় দৃষ্টান্ত।
ওঁ নমো নারায়ণায়। ওঁ নমঃ পরমহংসাস্বাদিতচরণকমলচিণ্মকরন্দায় ডক্তজনমানসনিবাসায় শ্রীরামচন্দ্রায়।।
বাঙালির লোকবিশ্বাস এবং লোক বিস্বাসে ভূত-পেত্নীকে তাড়াতে শ্রীরামের নাম করা হয়। বিশ্বাস যে শ্রীরাম নাম শুনলে ভূত-পেত্নীরা ভয়ে পালিয়ে যায়। ভূত-পেত্নীরা শ্রীরামনাম সহ্য করতে পারে না।
“ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি; রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমায় কি?
এর ব্যাখ্যাও রামায়ণে পাওয়া যায়
সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে। অভয়ং সর্বভুতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম।।
“কেউ যদি শরণাগত হয়ে একবার মাত্র বলে আমি তোমার, তবে আমি তাকে অভয় দান করি। এই আমার ব্রত।”
(রামায়ণ:যুদ্ধকাণ্ড, ১৮.৩৩)
রামময় বাঙালির প্রত্যেকটি মন্দিরে সন্ধ্যায় যে নামকীর্তন করা হয় তাতেও রাম নাম। এই নামকীর্তনের মধ্যে বর্তমানকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলো ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত
“হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।।”পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলে রামনবমী একসময় খুব প্রচলিত উৎসব ছিল। রামানন্দী সম্প্রদায়ের বিরাট বড় প্রভাব পূর্ববঙ্গে ছিল।পূর্ববঙ্গে বিয়ের গীত প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে এই অঞ্চলের বিয়ের লৌকিক অনুষ্ঠানগুলি সম্পর্কে দু চার কথা জেনে নেওয়া যেতে পারে । যেমন-
পাটি পত্র-পূর্ববঙ্গের বিবাহগীতিতে রামচন্দ্র
বিয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পত্র, সাধারণত পাত্রীর বাড়িতে দু পক্ষের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে বিবাহের সম্মতি , দিন, লগ্ন, ইত্যাদি দুটো কাগজে লিখে, দু পক্ষের অভিভাবকদের স্বাক্ষর ও ” মোহর ছাপ “( এক টাকার মুদ্রা সিঁদুর মাখিয়ে ছাপ ) ও হলুদ এর ফোঁটা দেওয়া হয় ।
এই সম্বন্ধে গীত
–
“ভাগ্যবতী সীতার মা /পন্ডিত পাঠাইলা না ll
পন্ডিত কয়, সীতার মা /দেশের ব্যবহার জানো না ll
পন্ডিত রে বৈসতে দেও /সুনার (সোনার )সিঙ্গাসন (সিংহাসন) দাও ll
ঝারি (গারু )ভইরা জল দাও / তাইতে ডাব নাইরকেল দাও ll
বাটা ভইরা পান দাও / তাইতে গুবাক -দারচিন মসলা দাও ll
কহ গিয়া সীতার/ বাপের ঠাঁই গো ll
পান -পানীয়র কার্য্য নাই /কহ গিয়া সীতার বাপের ঠাঁই গো ll
কিবা দিবা/সীতার বিয়ার যৌতুক গো… “
আবার পাত্রীর বাড়ি থেকে পাত্রপক্ষ নিজেদের বাড়ি ফিরলে, সেখানে গান গাওয়া হয় যেমন-
“কও কও পন্ডিত গো /আমার বৌ এর কুশল গো ।
আমার সীতার কুশল গো ll
সীতা আমার/ কেমন রূপের মুরলী গো ll
পন্ডিত এর উত্তর (এটাও অবশ্য” গীত গাওনি”রা ই দেয় )
… “আটন সীতার দেখলাম গো /যেন খঞ্জন গমন গো l
হাইত (হাত ) সীতার দেখলাম গো /যেন আলতার ফুল গো ll
অঙ্গুলি যেন চম্পক কলা ll
মুখ সীতার দেখলাম গো /পুন্নিমা র ই চন্দ্র গো l
দন্ত যেন দাড়িম্বরই ফলা ll
পান খিলি–পূর্ববঙ্গের বিবাহগীতিতে রামচন্দ্র
পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে বিয়ের পূর্বে পাঁচ বা সাত জন এয়োস্ত্রী একসাথে শীতলপাটিতে বসে নির্দিষ্ট সংখ্যক গোটা পান লম্বালম্বি ভাঁজ করে লবঙ্গ বা কুচি সুপারি দিয়ে আটকিয়ে দেয়। এটি একটি মঙ্গলাচার । এ বিষয়ে গান হলো
“পুরবাসী জন গো /সুপারি কাটো গো l
আইজ রামের বিয়ার /পান খিলি গো l
আইজ অমুক (পাত্রের নাম ) এর বিয়ার /পান খিলি গো ll
আইস আইস ভগিনী গো /পানে দাও খিল গো ll
হস্তে লও সুবর্ন এর ই /কাটারি গো ll ইত্যাদি।
ধান-হলুদ কোটা–পূর্ববঙ্গের বিবাহগীতিতে রামচন্দ্র
পূর্ববঙ্গের সর্বত্রই বিয়ের পূর্বে একটি শুভ দিন দেখে গায়ে হলুদ এর জন্য হলুদ গুঁড়ো করা হয় এবং নান্দিমুখ এর আতপ চাল তৈরী করা হয়। একে” ধান- হলুদ কোটা “বলে। বলা বাহুল্য এর অনেক নিয়ম কানুন আছে এবং এটা বিবাহ পূর্ব প্রধান মঙ্গলাচার ।
আইজ হইব হলদি কোটা /রামের হলদি কোটো গো ll
অমুক (পাত্রের নাম ) এর হলদি কোটো গো ll
কি কর গো রামের মা /ঘরেতে বসিয়া গো ll
হলদি কুটতে আয়ো (এয়ো )আইছে /পান সুপারি দাও গো ll
হলদি (বা ধান )কুটতে আয়ো আইছে /তৈল সিন্দুর দাও গো ll ইত্যাদি
গন্ধ তেল কোটা–পূর্ববঙ্গের বিবাহগীতিতে রামচন্দ্র
এটিও হলুদ কোটার দিন বা বিয়ের দিন সকালে পালিত একটি স্ত্রী আচার। বেনের দোকান থেকে আনা মসলা পাটায় গুঁড়ো করে, ছোট ঘট (এগুলো এই উপলক্ষেই কুমোররা তৈরী করেন ও দশকর্মা ভাণ্ডারে পাওয়া যায় । গায়ে সুন্দর চিত্রিত করা ও ওপরে ঢাকনা দেওয়া হয় ) ভর্তি সরষের তেলে মেশানো হয় । পাটকাঠিতে আগুন করে প্রতীকী ভাবে জ্বাল দেওয়া ও পাখার বাতাস দেওয়া হয়। এগুলো বারণডালাতে বসানোর জন্য ছোট ছোট তিন বা পাঁচটি মাটির গুলি তৈরী করা হয়। এই উপলক্ষে গাওয়া গীত—
“রামের মা লো ওওও, মাসি, খুড়ি /তারাও যায় লো, তৈল রন্ধনে এএএ ll
মৃত্তিকার ওওও, পঞ্চ ইটা /সুবর্ণর ইইই, পাতিল( ছোট হাঁড়ি )গোটা গোওওও ll
তাইতে দিলো, তৈল ঢালিয়া গো ওওও /আগর কাষ্ঠ এএ, চন্দন কাষ্ঠ এ / জ্বালিল আগুন গো ওওও ll
তাইতে দিল ওও, মেথির গুঁড়া গো ওও /জ্বালিলো আগুন গো ওওও ll
অনল জ্বালিয়া তাতে /দিল সোন্দরর গুঁড়া গো ওও ll
আগুন জ্বালিয়া তাতে /দিল জোড়া পান লো ওওও ll
পাতিল নামাইয়া তাতে, দিল পাখার বাতাস গো ওও ll
পাখার বাতাসে, কৈল/ তৈলওও শীতল গো ওও ll
মৌর (ময়ূর )পঙ্খ এর বাতাস দিয়া /কৈরলো তৈল শীতল গো ওও ll
শ্বেতচামর এর বাতাস দিয়া /করলো তৈল শীতল গো ll
রামবিগ্রহ -দাঁইহাট
অধিবাস–পূর্ববঙ্গের বিবাহগীতিতে রামচন্দ্র
মূলত নান্দিমুখের সময় করণীয় শাস্ত্রীয় আচার । পূর্ববঙ্গের বিয়েতে অধিবাসের পর পাত্র (বা পাত্রী) কে হলুদ মাখিয়ে এয়ো
বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর হুগলি হাওড়া মেদনিপুরে মুর্শিদাবাদ এবং পুরুলিয়ায় অসংখ্য রাম মন্দির রয়েছে। পুরুলিয়ার রাম মন্দির শিখর রাজবংশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। একইভাবে বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায় অসংখ্য রাম মন্দির রয়েছে।
সীতাকুণ্ড মন্দির বাংলাদেশের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান। লোককাহিনী অনুসারে এখানে সীতার পাতাল প্রবেশ করে।
রামায়ণের প্রভাব এখনও পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, ঝাড়খণ্ড, আসাম এবং ত্রিপুরা সহ সমগ্র বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে পাওয়া যায়।এ সকল অঞ্চলে বিশেষ করে তবে দক্ষিণবঙ্গে কেউ মৃত্যুবরণ করলে শ্রাদ্ধবাসরে বা শ্রাদ্ধকে উপলক্ষ করে রাত্রে রামায়ণ গান করা হয়। একজন প্রধান গায়ক থাকেন এবং তার পাঁচ বা সাতজন সহযোগী থাকে তারা গায়ককে বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে সহায়তা করেন। একে বলে ধ্রুবপদ বা স্থানীয় ভাষায় ‘ধুয়া টানা’ । এই রামায়ণ গানটি বাঙালির লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। রামায়ণের প্রভাব আজও জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতিতে।
লেখা: জ্যোতিষ্মান সরকার৷