কালের সাক্ষী কাশী! - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • May 24, 2023
  • Last Update April 29, 2023 5:58 pm
  • kolkata

∆কাশী

বলা হয় কাশী এসেছে সংস্কৃত ‘কুশ’ শব্দ থেকে যার অর্থ হল : চকচক করা, আলোকিত হওয়া ইত্যাদি। এও বলা হয় যে, হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা শিব নাকি কাশী শহরের প্রতিষ্ঠাতা। কাশী নগরটা শুরুতে তিন ক্ষুদ্রাকার পাহাড়ের ওপর স্থাপিত হয়েছিল। পদ্ম পুরাণ অনুসারে কাশী চিরকাল ছিল, এবং ইহা শিবের ত্রিশূলের ওপর ভোর করে আছে। স্বয়ম্ভূ শিব যেহেতু কাশীর প্রতিষ্ঠাতা এবং রক্ষকও বটে, তাই কাশী কখনও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সমস্যায় পড়বে না। কাশী চিরকাল এক ভাবে থেকে হিন্দু ধর্মের প্রতীক হিসাবে থেকে যাবে।

শিবের আলোয় আলোকিত পবিত্র নগরীকেই এক কোথায় কাশী বলে। সংস্কৃত ভাষায় কাশীকে অভিমুক্তাও বলে। অর্থাৎ যে নগর কখনই শিবকে ভুলে যাবে না। পুরাণ ও কিংবদন্তী অনুসারে শিব লিঙ্গম প্রথমবার এখানেই স্থাপন করেছিল। শিব এও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি কোনও অবস্থাতেই কাশীকে ভুলবেন না, এমনকি প্রলয়ের সময়েও না।

কাশী ও বারাণসী নামটা হিন্দুদের কাছে প্রায় সমার্থক। বরুণা ও অসির মধ্যবর্তী অংশে নগরীর স্থাপনা হয়েছিল বলেই নগরীর নাম বারাণসী। কাশী তার জন্মলগ্ন বরাবরই শিক্ষণ ও পঠনপাঠনের জায়গা হিসাবে শ্রেষ্ঠ স্থান হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। অথর্ব বেদের ভাষ্য অনুসারে কাশী শুধু একটা নগরী নয়, একটা সাম্রাজ্যও বটে। আর বারাণসী হচ্ছে কাশী রাজ্যের রাজধানী।

মহাভারতে অন্তত দুই মহাজনপদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়, কাশী ও অপারক্ষেয়।

বামন পুরাণের ভাষ্য অনুসারে বরুণা ও অসি নদী একেবারে আদি সময় থেকেই ঐ অঞ্চলে একভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। একটি অতিকায় পুরুষের দক্ষিণ পদ থেকে বরুণা ও বাম পদ থেকে নির্গত হচ্ছে। বামন পুরাণে এও বলা হয়েছে — এখানে এসে সঙ্গমস্থলে স্নান করলে সব পাপ মুছে যায়। এই কারণে কাশী শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান হিসাবে গণ্য হবে।

জাবাল উপনিষদের ভাষ্য অনুসারে — বারাণসী শব্দের উৎস হল ‘বারনা’ যার অর্থ হল সব পাপ দূর করে। আবার একে নাশীও বলা হয়, কেননা তা সব পাপ করার ইচ্ছাকে দূর করে। জাবাল উপনিষদে এও বলা হয়েছে যে, বারাণসী হচ্ছে এমন একটা জায়গা, যেখানে নাক ও ভ্রূ এসে মিলে যায়। বারাণসী হচ্ছে এমন একটা জায়গা, যেটাকে ত্রিশঙ্কুর প্রথম ধাপ বলা চলে। জাবাল উপনিষদ পাঠ করে আমরা জানতে পারি — কাশী হচ্ছে ছয় চক্রের মিলনস্থল।

আগেই বলেছি যে, কাশী তিন পাহাড়ের মাথায় প্রথম গড়ে উঠেছিল; কাশীর মানুষ বিশ্বাস করেন যে — পুরো নগরী শিবের ত্রিশূলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা মোটেই ভূমিকে স্পর্শ করছে না। এককালে কাশীর সীমারেখা ছিল অনেকটা রথের মত, তার বিস্তৃতি ছিল ১০ স্কোয়ার কিলোমিটার। পরবর্তী কালে গঙ্গা নদীর ভাঙনের পর নগরীর আকার কিছুটা বিকৃত হয়ে শঙ্খের আকার নেয়। কাশীর এই আকার ছোট হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পর্যন্ত আছে — ‘পঞ্চ কোশী পরিক্রমা’।

লুইস মেইনফোর্ড তার ‘সিটিজ ইন হিস্টোরি’ গ্রন্থে লিখেছেন — ‘কাশী হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম নগরী, যা প্রাণশক্তিকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করেছে’। মেইনফোর্ড এরকম কয়েকটা নগরীর তালিকা দিয়েছেন, যারা প্রাণশক্তিকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করেছে। যেমন আথেন্স, কাইরো, মক্কা, বেইজিং, রোম ইত্যাদি। বলা বাহুল্য কাশীর মতই উপরোক্ত নগরীগুলি এক সময়ে সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল। এবং একইসাথে তা তীর্থস্থলও ছিল বটে।

ভারতের প্রাচীনতম নগরীর মধ্যে কাশীর নাম সর্বাগ্রে আসবে। অন্তত ৪০০০ বছরের প্রাচীন এই নগরী প্রথমে একটি নগরী থেকে ধীরে ধীরে একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। কাশী যুগপৎ নগরী ও সাম্রাজ্য হিসাবে সমার্থক ছিল।

বৌদ্ধ জাতক কাহিনীতে বহুবার কাশী ও বারাণসীর উল্লেখ আছে। সেখানে কিছু জায়গায় কাশীপুর ও কিছু জায়গায় কাশীনগর নামেও উল্লেখিত হয়েছে। তবে আদি ভারতীয় সাহিত্যে নগরীকে সর্বদাই বারাণসী হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশদের হাত ধরে কাশী নামটা বেশী ব্যবহৃত হতে থাকে। তাদের জন্যই বারাণসী নামটা পাল্টে বেনারস হয়ে যায়।

হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে বারাণসী ও কাশী দুই নামই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। দুই ক্ষেত্রেই নগরকে ‘ধর্মক্ষেত্র’ হিসাবে উল্লেখিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পূর্বে ‘ধর্মক্ষেত্রের’ পরিধি তত বড় ছিল না। গঙ্গার পশ্চিম প্রান্তে কাশী নগরীর অস্তিত্ব ছিল না। মহাভারতে প্রথমবার যে ধর্মক্ষেত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা বরুণা নদীর দুই প্রান্তেই বিস্তৃত ছিল।

পদ্ম পুরাণ অনুসারে কাশী নগরী দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থলে অবস্থিত ছিল। পূর্বপ্রান্তে অসি ও পশ্চিম প্রান্তে বরুণার মাঝখানের ভূখণ্ডই পরবর্তীকালে বারাণসী নামে পরিচিত হয়। অ্যালফ্রেড ক্যানিংহ্যাম সাফ জানান, বারাণসী বরাবরই দুই নদীর মাঝখানে ছিল।

বৈদিক সাহিত্যে কাশীর উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্য অনুসারে কোশল, মগধ ও কাশী রাজ্য পাশাপাশি অবস্থিত ছিল। অথর্ব বেদে বর্ণাবতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার তীরে কাশী অবস্থিত ছিল। পরবর্তীকালে কোনও প্রাকৃতিক কারণে বর্ণাবতী নদী হারিয়ে গিয়েছে।

ৎসুয়ানৎসাং এর বর্ণনা অনুসারে, কাশী রাজ্যের আয়তন ছিল ১৭২৭ স্কোয়ার কিলোমিটার (৬৬৭ স্কোয়ার মাইল)। ৎসুয়ানৎসাং এও লিখেছেন ১০ স্কোয়ার কিলোমিটার (৩ স্কোয়ার মাইল)। বারাণসী নগরী কাশীর পশ্চিম ধারে গঙ্গার তীরে অবস্থিত। সেখানে সব মিলিয়ে ১০০র বেশী মন্দির ছিল, যার অর্ধেক ছিল শিবের। ৎসুয়ানৎসাং এর মতে, তিনি কাশীর মত এত জনঘনত্ব কোথাও দেখেন নি। সেখানে আম থেকে শুরু করে সব রকম ফলের চাষ হত।

মেকলের মত ভারত বিদ্বেষী মানুষও কাশীর মাহাত্ম্য এইভাবে বর্ণনা করেছেন — “কাশী সম্ভবত এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ নগরী হিসাবে বিবেচিত হবে। এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, বৈভব, জনসংখ্যা, ধর্মীয় মাহাত্ম্য — সব দিক দিয়েই কাশী অতুলনীয়। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি কোনও দেশের রাজধানী না হওয়া হওয়া সত্ত্বেও কাশীতে যত মানুষ বসবাস করে, বোধহয় কলকাতা বা লন্ডনেও অত লোক থাকে না। কাশীতে যত ধর্মস্থান দেখেছি, তেমনটি কোথাও দেখিনি। কাশীর অনেক রকম শিল্প আছে, কিন্তু রেশমের বস্ত্র সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। বেনারসী রেশমের বস্ত্র পৃথিবীর সব দেশের রাজপরিবারের কাছে সমাদৃত, যেমনটা বাংলার মসলিন ও গোলকুণ্ডার অলঙ্কার আর কাশ্মীরের শাল সর্বত্র জনপ্রিয়। কাশীর বাজারের মত গোলকধাঁধা আমি কোথাও দেখিনি।”

মাইকেল শেরিং নামে জনৈক খৃষ্টান মিশনারী এই বারাণসীতেই তার জীবনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় কাটিয়েছেন। তিনি বারাণসী সম্পর্কে লিখেছেন, “বারাণসী সত্যিই এক অতুলনীয় স্থান। আমি বারাণসীর লোক নই, এমনকি ভারতের লোক পর্যন্ত নই। তার পরেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি কাশীর মত জায়গা ভারতে তো বটেই, পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। পৃথিবীর ইতিহাসেও কাশীর একটা আলাদা, স্বতন্ত্র স্থান আছে। বারাণসী হচ্ছে ভারতের ‘প্যারিস’। কি বৌদ্ধিক, কি ধর্মীয় — দুভাবেই। বারাণসী ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে, এটা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, যেমনটা প্যারিস ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। পৃথিবীতে খুব কম শহরই আছে, যা এক একটা দেশের সংস্কৃতিতে এত বছর ধরে বহন করে চলেছে। বারাণসীকে অনায়াসে দুটি ধর্মের ‘জন্মস্থান’ বলা চলে — হিন্দু ও বৌদ্ধ। এখানে স্মর্তব্য, দুই ধর্মই খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে খৃষ্টীয় একাদশ শতক পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক দেশের রাষ্ট্রধর্ম ছিল। সে হিসাবে বারাণসীকে স্বচ্ছন্দে যুগপৎ হিন্দু ও বৌদ্ধ বিশ্বের রাজধানী বলা চলে।”

আগেই বলেছি যে, কাশী নামটা এসেছে কাশ নামক এক পৌরাণিক শাসকের নাম থেকে। এই কাশেরই বংশধর ছিলেন ঐতিহাসিক বৈদিক যুগীয় শাসক দিবোদাস। অবশ্য ইতিহাসবিদরা এও বলেন যে, কাশী এসেছে এখানকার বিখ্যাত কাশবন থেকে। মহাভারতেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে কাশবন থেকেই কাশী নামকরণ হয়েছে।

পদ্মপুরাণ অনুসারে বারাণসীর বিস্তৃতি দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে জন্ম নিয়ে গঙ্গার কাছাকাছি এসে থেমে গিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, গঙ্গার উত্তরে অবস্থিত রাজঘাটের কাছে মালভূমি থেকে উৎপত্তি হয়ে গঙ্গায় এসে থেমে গিয়েছে বারাণসী শহর। রাজঘাট থেকেই যে বারাণসীর উদ্ভব হয়েছে, তার প্রমাণ একাধিক বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। ঐসব সাহিত্যেই বলা হয়েছে যুগপৎ বরুণা ও অসি নদী বৃষ্টির জলে পুষ্ট হয়, বাকি সময়ে জল থাকে না বললেই চলে।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনা এরকম

মিথিলার জনকপুরের খ্যাতি ছিল দার্শনিক বিষয়ের ওপর অগাধ জ্ঞানের জন্য। সে সময়ে বারাণসীর শাসক অজ্ঞাতশত্রুকে সবাই মহান দার্শনিক হিসাবে চিনতেন। তিনি একদিন গার্গেয় বাল্কির জ্ঞানের সুখ্যাতি শুনলেন। অজ্ঞাতশত্রু তার কাছে গেলেন। তখন গার্গেয় বাল্কি তাকে বললেন, তিনি তার ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী — তবে, মিথিলায় নয়, কাশীতে। এতে অজ্ঞাতশত্রু খুবই খুশি হলেন। অতঃপর দুইদিন ধরে আলোচনা চলার পর অজাতশত্রু প্রমাণ করলেন গার্গেয় বাল্কির দর্শনে ভ্রান্তি আছে। এই ঘটনার পর বারাণসী ‘ব্রহ্ম বর্ধন’ নামে পরিচিত হতে লাগল।
পালি সাহিত্যে বারাণসী নামটার উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত দেখা যায়। ব্রিটিশ আমলে বারাণসী বেনারসে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর বারাণসী, কাশী ও বেনারস — এই তিন নামই চলতে থাকে। কাশীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নাম হচ্ছে আনন্দবন। এই জায়গাটার নাম প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায়। কেননা এই আনন্দবন হচ্ছে রাজঘাট মালভূমির সেই অংশ, যেখানে বারাণসী জনপদ স্থাপিত হয়েছিল। এই আনন্দবন ছিল কাশীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান, সেজন্য সন্ন্যাসীরা এখানে এসে ধ্যান করতেন। তাছাড়া জনমানববর্জিত জায়গা বলে জ্ঞানচর্চা করার জন্যও পণ্ডিতরা এখানে এসে বসতেন। কাশীর বর্ণনা সম্পূর্ণ হবে না, যদি না পঞ্চ কোশীর কথা উল্লেখ করি। ৫ কোশ বা ক্রোশ দুই মাইল (৩.২ কিলোমিটার) দূরত্বের সমান। গঙ্গায় এসে পঞ্চ কোশীর আকার সম্পূর্ণ বৃত্তাকার হয়। পঞ্চ কোশী শুরু হয় কাশীর বিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দির দিয়ে। নিয়ম আছে এই পুরো পাঁচ ক্রোশ পথই পদব্রজে সম্পূর্ণ করতে হবে, নতুবা কাশী তীর্থ করা সম্পূর্ণ হবে না। এই পঞ্চ কোশী যাত্রা যেকোনো নিষ্ঠাবান হিন্দুর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই পরিক্রমার মাধ্যমে কাশীর ঐতিহাসিক স্থাপত্য

দীঘা নিকায় গ্রন্থের মহাগোবিন্দ সূক্তে বলা হয়েছে যে, বারাণসী নগরী গৌতম বুদ্ধের জন্মের অন্তত পাঁচশ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। সেখানে জনৈক বারাণসী শাসক রেণুর প্রধানমন্ত্রী মহাগোবিন্দ নাকি কাশী নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ‘সাংখ্য শ্রৌত সূত্রের’ ১৫:২৬:১ শ্লোকে বলা হয়েছে রেণু হচ্ছেন মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র। ঋগ্বেদে পরুশ্নি নদীর তীরে বিশ্বামিত্রের শোচনীয় পরাজয়ের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। আর্যরা ভারতে আসার পর যেসব শহরে প্রথম সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল, তার মধ্যে কাশী অন্যতম। পুরাণ অনুসারে বারাণসীর শাসকদের নাম ক্রমানুসারে দেওয়া হল —

১. দিবোদাস
২. অষ্টরথ
৩. হয়াশ্ব
৪. সুদেব
৫. দ্বিতীয় দিবোদাস
৬. প্রতর্দন
জৈন সাহিত্য অনুসারে খৃষ্টীয় প্রথম শতকে কাশী আর বারাণসী ছিল সমার্থক। প্রাচীন বারাণসী নগরের ধ্বংসাবশেষ রাজঘাট মালভূমি খনন করে পেয়েছেন আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসাররা। খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বছরের ইতিহাস ধরা পড়েছে ঐ উৎখননের ফলে। সেখানে যে ধরণের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে, প্রায় একই ধরণের স্থাপত্য এখনও কাশীর অলি গলিতে গেলে পাওয়া যায়। দেখলে মনে হবে ২৫০০ বছর ধরে কিছুই পাল্টায় নি।

কাশী নগরীর জন্ম ও উত্থানের ইতিহাস, কি রোম, কি আথেন্স, কি ইস্পাহান, কি বেইজিং — এর চেয়েও প্রাচীন। একমাত্র জেরুসালেম বয়স ও ঐতিহ্যের দিক থেকে কাশীর সাথে পাল্লা দিতে পারে। এই কারণেই মার্ক টোয়াইন সারা বিশ্ব ভ্রমণ শেষে তার গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “আমার মনে হয়েছে বারাণসী বোধহয় ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন, ঐতিহ্যের চেয়েও পুরাতন, কিংবদন্তীর চেয়েও প্রাচীন এবং যতটা অনুমান করা যায় তার চেয়েও পুরাতন।” তারপরেই টোয়াইন লিখেছেন, “এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে, বারাণসী বাকি শহরের মত রাজনৈতিক ভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হয়েও ইতিহাসে অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। বলা হয় এই নগরী ভগবান শিবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তিনিই এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা। আমি বারাণসীর মত এমন একটা নগরী পৃথিবীতে কোথাও পাইনি, যাকে একটি ধর্মের প্রধান কেন্দ্র বলা যায়। এমনকি ভ্যাটিকান বা মক্কাও এই জায়গায় পৌঁছবে না। বারাণসীই ভারতের যথার্থ প্রতীক।”

বলা হয় কাশীর প্রথম শাসক রেণু এখানেই প্রথম অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে হিন্দু সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। তিনি কুরু ও পাঞ্জাল রাজ্যকে হারিয়ে জয়ের স্মারক হিসাবে অশ্বমেধ যজ্ঞ শুরু করেছিলেন। বৌদ্ধ জাতক অনুসারে বারাণসী ছিল জম্বুদ্বীপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিন নগরীর একটি। মহাভারতে কাশীর উল্লেখ পাওয়া যায়, শাসক কাশীরাজ পাণ্ডবদের হয়ে যুদ্ধে লড়েছিলেন। তবে কাশীরাজের প্রকৃত নাম, তার সেনাবাহিনীর বর্ণনা মহাভারতে সেভাবে পাওয়া যায় না।

মহাভারতে কাশীর উল্লেখ পাওয়া যায় যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে, যেখানে বলা হয়েছে যাদব সেনা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে কাশীকে আক্রমণ করে এবং নগরীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফিরে যায়। এরপর থেকে কাশীর সাথে কোশল ও মগধের মধ্যে বহুকাল ব্যাপী সংঘাত বাঁধতে থাকে। ষোড়শ মহাজনপদ যুগেও এই ত্রিমুখী সংঘাত চলতেই থাকে। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে মোহম্মদ ঘোরির নেতৃত্বে মুসলিমরা কাশীকে আক্রমণ করেছিল। দিল্লী সুলতান ও মুঘল আমল ছিল বারাণসীর পক্ষে অত্যন্ত খারাপ সময়ে। এই পাঁচশ বছরে অসংখ্য মন্দির ভাঙ্গা হয়েছিল বিভিন্ন অজুহাতে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে কাশীর একটি শিবমন্দির ভেঙ্গে তার ওপর জ্ঞানব্যাপী মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন। এখনও জ্ঞানব্যাপী মসজিদ দেখলে বোঝা যায় সেটা মন্দির ভেঙ্গেই তার ওপর তৈরি হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের সময়ে বারাণসীর হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সঙ্ঘাতের পরিবেশ বহুকাল ধরে চলেছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরেও সংঘাত সহজে শেষ হয়নি। এরপর কাশী মহারাজা মনসা রামের হাতে চলে এলে অবশেষে দাঙ্গার ইতিহাস বন্ধ হয়। তার ছেলে বলবন্ত সিংহের হাতেও সেই ধারা অব্যাহত থাকে। তিনি গঙ্গা নদী জুড়ে রামনগর দুর্গ নির্মাণ করেন। এর ফলে মুসলিমদের পক্ষে চট করে কাশী আক্রমণ করা কঠিন হয়ে ওঠে।

তবে কাশী বৈদিক যুগ থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা, দর্শন, সংস্কৃতি, চারুকলা ও হস্তশিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল। কাশী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা বরাবরই উত্তম কৃষিক্ষেত্রের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এছাড়া বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবেও যথেষ্ট পরিচিত ছিল।

বারাণসীতে স্থিত কিছু শৈক্ষণিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় তক্ষশীলার চেয়ে প্রাচীন। এও বলা হয় যে, দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিয়মিত সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হত। বারাণসী থেকে স্নাতক ছাত্ররা তক্ষশিলায় পড়াতে যেতেন আর তক্ষশীলা থেকে স্নাতক ছাত্রমণ্ডলী বারাণসীতে পড়াতে আসতেন। বারাণসীর বণিকদের বলা হত শ্রেষ্ঠী, জাতক ও পুরাণে এদের আর্থিক সম্পদের কথা বহুবার বলা হয়েছে। জাতকে উল্লেখ আছে শ্রেষ্ঠীরা নাকি প্রতিদিন এক মণ (প্রায় ৩০ কিলোগ্রাম) পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রা ও তাম্রমুদ্রার লেনদেন করতেন। এথেকে অনুমান করা যায় এরা কিরকম ধনী ছিলেন।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, শুধু বাণিজ্য, শিক্ষা বা সংস্কৃতি নয় — এখানে হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মচর্চার যথেষ্ট প্রসার ঘটেছিল। গৌতম বুদ্ধ প্রথমবার কাশীর কাছে সারনাথে ধর্ম-চক্র-প্রবর্তন নামক ধর্মসভার আয়োজন করেছিলেন। এই সারনাথ পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের ‘ভ্যাটিকানে’ পরিণত হয়। বিংশ শতকে সারনাথে বৌদ্ধ জনপদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের দায়িত্বে ছিলেন সেই দয়ারাম সাহনিই।

তবে কাশী জুড়ে প্রথমবার বৈজ্ঞানিক প্রথায় প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন শুরু হয় ১৮১৫ সালে, অ্যালফ্রেড ক্যানিংহ্যামের নেতৃত্বে। এরপরেই ইতিহাসবিদদের মধ্যে কাশী নিয়ে আগ্রহ দেখা যায়। খননের পর রাজঘাট মালভূমির নিকট ‘ইসিপত্তন’ নামক প্রাচীন জনপদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা বয়সে কাশীর চেয়েও প্রাচীন।এখানে যা যা নিদর্শন পাওয়া গেছে, সবই কলকাতা যাদুঘরে সংরক্ষিত রাখা আছে। সারনাথের কাছে ‘লায়ন ক্যাপিটাল’ পাওয়া গেছে, যা কিনা আজ ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসাবে গণ্য হয়। কাশীতে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি সবই খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতক প্রাচীন বলে অনুমান করা হয়।

দুই বিখ্যাত চীনা পর্যটক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফা হিয়েন ও ৎসুয়ানৎসাং তাদের গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধ সারনাথের যে অংশে বসে প্রথমবার ধর্ম-চক্র-প্রবর্তন শুরু করেছিলেন, সেই অংশে কত বড় স্তূপ আছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। একথা সবাই জানেন যে, বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে কাশী বা বারাণসীর একটা ভূমিকা আছে। হিন্দু ধর্মের মতই বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগীদের কাছেও অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বারাণসী নগরী থেকে সারনাথ খুব বেশী দূরে অবস্থিত নয়।

গ্রীকদের হৃদয়ে আথেন্স, ইতালিয়ানদের হৃদয়ে রোম, ফরাসীদের হৃদয়ে প্যারিস যে জায়গা পায়; ভারতীয়দের (হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) কাছে বারাণসী ঠিক সেই জায়গা অধিকার করে আছে। অসংখ্য শিব মন্দিরের উপস্থিতির কারণে বারাণসীকে অনায়াসে শিব মন্দিরের শহর বলা হয়। বারাণসীর মত এত বেশী শিব মন্দির ভারতের কোনও শহরে নেই।

বারাণসীর উল্লেখযোগ্য মন্দিরের মধ্যে ভৈরোনাথ অন্যতম। এখানকার শিব বিগ্রহকে স্থানীয় মানুষ বারাণসীর ‘কোতোয়াল’ বলে মনে করে। এনার ‘রাজত্বে’র সীমা পঞ্চ কোশীতে এসে শেষ হয়েছে। স্থানীয় মানুষ মনে করে ভৈরোনাথ অশুভ আত্মা ও খারাপ মানুষকে বারাণসীর বাইরে রেখে দেয়, তাকে ঢুকতে দেয় না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে, ভৈরোনাথ যে থানার অধীনে পড়ে, সেখানে বিগত ২০০ বছর ধরে একটাও ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা হয়নি — না চুরিডাকাতি, না পকেটমারী, না খুনজখম, না নারীদের ওপর অত্যাচার : কিছুই হয়নি। ভৈরোনাথের বিগ্রহও অদ্ভুত দেখতে — তার ডান হাতে রয়েছে একটা মুগুর, সেটা আদ্যপান্ত গ্রানাইট পাথরের তৈরি ও অত্যন্ত কারুকার্যময়। ভৈরোনাথের মুগুরকে ‘দণ্ডপাণি’ বলা হয়। একই রকম মুগুর অন্য মন্দিরেও দেখতে পাওয়া যায়। প্রতি মঙ্গলবার ও রবিবার ভৈরোনাথের আরতি সম্পন্ন হয় এবং এই দুদিন বহু মানুষ এসে পূজা দেয়। প্রধান পুরোহিত ভৈরোনাথের উল্টোদিকে মুখ করে অর্থাৎ দর্শনার্থীদের দিকে মুখ করে ময়ূরের পালক হাতে বসে থাকেন। তার কাছে দর্শনার্থী গেলেই তিনি ময়ূরের পালক একবার দণ্ডপাণিকে ছুঁয়ে তারপর ময়ূরের পালক দর্শনার্থীর মাথায় ঠেকান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দণ্ডপাণি শিবের এক অনুচরের নাম।

মন্দিরের বাইরের অংশে দেওয়ালে দণ্ডপাণি ও তার বাহন, কুকুরের চিত্র আছে। এখানে মন্দিরে কুকুর প্রবেশ করতে পারে, প্রসঙ্গত হিন্দু মন্দিরে কুকুরের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ভৈরোনাথ ও দণ্ডপাণি মন্দিরের মাঝখানে একটি মন্দির আছে — নবগ্রহ। বারাণসী জুড়ে অনেকগুলি গণেশ মন্দির আছে। বারাণসীতে যেসব মন্দির অত্যন্ত বিখ্যাত ও সারা বছর ধরে দর্শনার্থীতে ভর্তি থাকে, তা হল — ধুন্দিরাজ, সংকটমোচন, দুর্গা, ভবানি, কাশী দেবি, গঙ্গা ও বিশ্বনাথ ইত্যাদি। ধুন্দিরাজ মন্দিরকে কাশীর সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। অনুমান করার হয় ধুন্দিরাজ ২০০০ বছরের প্রাচীন।

কাশীর মন্দিরগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত মন্দির হল কাশী বিশ্বনাথ। এই মন্দির কাশীর সবচেয়ে সরু গলির মধ্যে অবস্থিত। ভারতের প্রত্যেক শৈব মতাবলম্বীর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জীবনে একবারের জন্য হলেও বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করা। ভারত তো বটেই, সারা বিশ্বের প্রত্যেক প্রান্তে থাকা ভারতীয় হিন্দুরা এই মন্দির দর্শন করেন। বলা হয় মূল মন্দির ১৬৭০ সালে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে মুঘল সেনাবাহিনীর দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়। তৎকালীন বিশ্বনাথ মন্দিরের পুরোহিত সম্ভাব্য হানার সংবাদ পেয়ে মূল বিগ্রহ গঙ্গায় ফেলে দেন। এরপর তিনি সাঙ্কেতিক ভাষায় অন্যত্র গঙ্গায় মূল বিগ্রহের সংবাদ পাঠিয়ে দিয়ে নিজে আত্মহত্যা করেন। কেননা তার আশঙ্কা ছিল যে, মুঘলরা বিগ্রহ না পেয়ে তার ওপর অত্যাচার চালাবে। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অনেক বাদে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মিত হয়, এবং সে সময়েই সাঙ্কেতিক চিঠির মাধ্যমে বিগ্রহ উদ্ধার করে মন্দিরের ভেতরে পুনর্স্থাপিত করা হয়।

বিশ্বনাথ মন্দির আবার বিশ্বেশ্বর নামেও পরিচিত। এই মন্দিরকে স্বর্ণমন্দির নামেও ডাকা হয়। কেননা এর শিখর সোনা দিয়ে বাঁধানো। কথিত আছে শিখ শাসক রণজিৎ সিংহ মুসলিমদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রচুর মুক্তিপণ মন্দিরে দান করেন এই শর্তে, মন্দিরের শিখর সোনা দিয়ে বাঁধাতে হবে। বিশ্বনাথ মন্দিরের উচ্চতা ৫১ ফুট। মন্দিরের ভেতরে যে ঘণ্টা আছে, তা নেপালের মহারাজা দান করেছিলেন। প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, যার পাশেই বিশ্বেশ্বর মন্দির গড়ে উঠেছে; তা এখনও দেখা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীন মন্দিরের উচ্চতা ছিল ১৫১ ফুট, যেখানে আধুনিকটার উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট কম।

বারাণসীর ঘাটগুলিও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রাখে বৈকি। বারাণসীর উৎস যেখান থেকে সেই রাজঘাট মালভূমির কাছেও উৎখনন করে আজকের ঘাটের মত দেখতে প্রাচীন ঘাটের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা কয়েক হাজার বছরের পুরানো। ইতিহাসবিদরা দেখে অবাক হয়ে গেছেন যে, প্রাচীন বারাণসীর ঘাটের সাথে আধুনিক কাশীর ঘাটের কাঠামোর বিশেষ পার্থক্য নেই।

দশাশ্বমেধ ঘাটকে অনায়াসে বারাণসীর সবচেয়ে ঐতিহাসিক স্থান বলা চলে। বলা হয় পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রের বিখ্যাত ঘটনাটা এখানেই ঘটেছিল। এই ঘাটে কমপক্ষে দশটা অশ্বমেধের ঘটনা ঘটেছিল বলেই নাকি এমন নামকরণ।

এরপর মণিকর্ণিকা ঘাটের কথায় আসা যেতে পারে। বলা হয় কাশীর সবচেয়ে পবিত্র ঘাট হচ্ছে এই মণিকর্ণিকা। এখানে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ মানুষ স্নান করে পাপ মুক্ত হন। এই ঘাটের ওপর ভগবান বিষ্ণুর চরণচিহ্ন আছে। মণিকর্ণিকার উৎপত্তি নিয়ে দ্বিমত আছে। প্রথম মতানুসারে দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করলে মহাদেব সতীশোকে উন্মত্তাবস্থায় সতীদেহ স্কন্ধে বহন করে পৃথিবী ভ্রমণ করতে থাকলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দ্বারা দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলেন। সতীর কর্ণাভরণ কুণ্ডল এখানে পতিত হয়েছিল। সেই থেকে জায়গাটা মণিকর্ণিকা নামে তীর্থ রূপে গণ্য।

দ্বিতীয় মতানুসারে মহাদেব নিজের ত্রিশূলের উপর কাশী নির্মাণ করে তার ওপর সব দেবের সন্নিবেশ করলে বিচলিত বিষ্ণু মহাদেবের উপাসনা করে নিজের সুদর্শন চক্র দিয়ে মাটি খুঁড়ে জলোত্তলন করেছিলেন বলে সেই জায়গাটা চক্রতীর্থ নামে পরিচিত হয়। এই মণিকর্ণিকা ঘাটেই একটা শ্মশান আছে।

বারাণসীর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ঘাটগুলি হল —

১. নারদ ঘাট
২. কেদার ঘাট
৩. জরাসন্ধ ঘাট
৪. অসিসঙ্গম ঘাট
৫. তুলসী ঘাট
৬. গণেশ ঘাট
৭. মহাশ্মশান ঘাট
৮. শিবালয় ঘাট
৯. দণ্ডী ঘাট
১০. মানমন্দির ঘাট
১১. পঞ্চগঙ্গা ঘাট
১২. দুর্গা ঘাট
১৩. চৌষট্টি যোগিনী ঘাট
১৪. সুরভী ঘাট
১৫. ত্রিলোচন ঘাট
১৬. সিন্ধিয়া ঘাট
১৭. পিশাচমোহন ঘাট

কাশীর বিখ্যাত মন্দিরগুলির মধ্যে এগুলি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ —

১. বিশ্বনাথ
২. অন্নপূর্ণা
৩. সংকটমোচন
৪. কালভৈরব
৫. তুলসী মানস
৬. দুর্গা কুণ্ড
৭. ভারত মাতা
৮. বিশালাক্ষী
৯. ত্রিদেব
১০. নয়া বিশ্বনাথ
১১. মৃত্যুঞ্জয় মহাদেব
১২. নেপালি

এইভাবে মন্দির ও ঘাটের উপস্থিতির কারণে ধীরে ধীরে কাশী সারা বিশ্বের কাছে ভারতের ধর্মীয়, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মক রাজধানী হয়ে উঠেছে। কাশীর মত এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নগরী ভারতে তো বটেই, বিশ্বে কোথাও নেই।

লেখা: অয়ন চক্রবর্তী। 

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *