Home - ভারত - শক্তিপূজায় ‘বলি’ কী আবশ্যকীয় উপাচার?
সনাতন ধর্মে পশুবলি প্রথা দৃষ্টিকটু মনে হলেও, বেদসহ সনাতন শাস্ত্রে বলি নিষিদ্ধ নয়। ঋগ্বেদ সংহিতায় বলির পশু অশ্বের উদ্দেশ্য বলা হয়েছে- দেবতাদের উৎসর্গ করার পরে উৎসর্গিত পশুটি দেবতাদের নিকটে গমন করে। কিন্তু পশুটিকে বলি প্রদানের সময়ে তার প্রিয় দেহটিকে অধিক ক্লেশ প্রদান করা বাঞ্ছনীয় নয়। খড়্গ যেন পশুটির শরীরে অধিকক্ষণ না থাকে এবং কোনো মাংসলোলুপ, ছেদনে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা যেন বলিকর্ম সম্পাদন করা না হয়। অর্থাৎ বলির পশুটিকে পুচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে বহুক্ষণ ধরে যেন হত্যা করা না হয়। এক কোপে বলির পশুটিকে ছেদন করতে হবে। দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত পশুকে বলি প্রদান করলে, তা কখনো হিংসা হয় না; বরং তা হিংসারহিত কর্ম। বলিকৃত যজ্ঞের পশু উত্তম পথে দেবতাদের নিকটে গমন করে মুক্ত হয়। এর মাধ্যমে যজমান শোভন গো-অশ্ব সমৃদ্ধ এবং পুত্রসন্তানযুক্ত বিবিধ জগৎপোষক ধন এবং প্রভুত্ব বা শারীরিক বল লাভ করে।
” হে অশ্ব, তুমি যখন দেবতাদের নিকটে গমন করো, তখন তোমার প্রিয় দেহ যেন তোমাকে ক্লেশ প্রদান না করে, খড়্গ যেন তোমার অঙ্গে অধিকক্ষণ না থাকে। কোনো মাংসলোলুপ ও ছেদনে অদক্ষ ছেদক অস্ত্রের দ্বারা ব্যর্থভাবে যেন তোমার অবয়ব ছিন্ন না হয়।
হে অশ্ব, তুমি মৃত্যুবরণ করছো না বা তোমায় কেউ হিংসা করছে না, তুমি উত্তম পথে দেবতাদের নিকটে গমন করছো। ইন্দ্রের হরি নামক অশ্বদ্বয় এবং মরুৎগণের পৃষতীনামক বাহনদ্বয় তোমার রথে যোজিত হবে, অশ্বিনীদ্বয়ের বাহন রাসভের পরিবর্তে কোনো দ্রুতগামী অশ্ব তোমার রথে সংযুক্ত হবে।
এই অশ্ব আমাদের শোভন গো-অশ্ব সমৃদ্ধ এবং পুত্রসন্তানযুক্ত বিবিধ জগৎপোষক ধন প্রদান করুক। অদিতি আমাদের অপরাধহীন করুক।এই অশ্ব যেন হবিঃযুক্ত হয়ে আমাদের প্রভুত্ব বা শারীরিক বল প্রদান করে।”
দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশুবলিতে বধকৃত পশুটি যে মুক্ত হয়ে সুগম দেবযান পথে দেবতাদের নিকটে গমন করে -এ বিষয়টি ঋগ্বেদ সংহিতার ন্যায় শুক্লযজুর্বেদ সংহিতাতেও বর্ণিত হয়েছে।
“হে অশ্ব ! এই যে তুমি আমাদের দ্বারা কর্তিত হ’তে যাচ্ছ, তবে তোমার মরণ হবে না ও তুমিও বিনষ্ট হবে না। বলি পরবর্তী তুমি সুগম দেবযান পথে দেবতাদের নিকটে গমন করবে। যে স্থানে পুণ্যবানগণ নিবাস করেন এবং যে স্থানে তাঁরা গমন করেন, সেই পুণ্যবানদের জ্যোতির্ময় লোকে তোমাকে সবিতাদেব স্থাপন করুক ৷”
বেদসহ সনাতন অধিকাংশ শাস্ত্রেই পশুবলির কথা থাকলেও শুধুমাত্র বৈষ্ণব দর্শনে পশুবলির আবশ্যকতা পাওয়া যায় না। এর অন্যতম কারণ বৈষ্ণব দর্শন ও উপাসনায় অহিংসা তত্ত্বের প্রভাব এবং শ্রীরামানুজাচার্য, শ্রীমধ্বাচার্য, শ্রীনিম্বার্ক এই প্রধান চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধান আচার্যবৃন্দ সকলেই দক্ষিণ ভারতের; আর বলার অপেক্ষা রাখে না, দক্ষিণ ভারতে ঐতিহাসিকভাবেই নিরামিষাশী প্রভাব প্রবল। সেখানে বহু মুসলিম এবং খ্রিস্টানরাও নিরামিষাশী।এই নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসেরই সরাসরি প্রভাব পরেছে বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলোর উপরে। তবে বৈষ্ণব দর্শনে পশুবলি না থাকলেও বৈষ্ণবশাস্ত্রের বিবিধস্থানে পশুবলির কথা রয়েছে। বেদের পরে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধানতম গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে ধূপ, প্রদীপ, উপহার এবং বলি দ্বারা দেবীকে পূজা করতে বলা হয়েছে, তবেই দেবী সন্তুষ্ট হয়ে ভক্তের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন।
“হে দেবী! সুরা ও মাংস, ভক্ষ্য ও ভোজ্য দ্বারা তোমায় পূজা করলে তুমি প্রসন্ন হয়ে মনুষ্যগণের সর্ব প্রার্থিত বিষয় প্রদান করবে।”
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্ধে আরও পাওয়া যায়, ব্রজের গোপীগণও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার উদ্দেশ্যে বলি প্রদানসহ দেবী কাত্যায়নী ভদ্রকালীর অর্চনা করতেন।বৃন্দাবনের গোপকুমারীরা অতি প্রত্যূষে সূর্যোদয়ের পূর্বে যমুনার জলে স্নান সেরে নদীর তটভূমিতে বালুকাময় মাটি দিয়ে দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে চন্দনাদি গন্ধদ্রব্য, সুগন্ধি পুষ্পের মালা, বলি, ধূপ, দীপ, নানাপ্রকার উপহার দ্রব্য, পল্লব, ফল এবং তণ্ডুলাদির দ্বারা কাত্যায়নী, মহামায়া, মহাযোগিনী, অধীশ্বরী ভদ্রকালীর পূজা করতেন।
“শ্রীশুকদেব বললেন- বললেন—পরীক্ষিৎ ! এরপর হেমন্ত ঋতুর প্রথম মাস অর্থাৎ মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ মাসে নন্দমহারাজের ব্রজভূমির কুমারীগণ দেবী কাত্যায়নীর পূজা তথা ব্রত আচরণে প্রবৃত্ত হলেন। এই সময়ে তাঁরা শুধুমাত্র হবিষ্যান্নই গ্রহণ করতেন।
মহারাজ ! গোপকুমারীরা অতি প্রত্যূষে দিগন্তে অরুণাভাস দেখা দিতে না দিতে যমুনার জলে স্নান সেরে জলসমীপেই তটভূমিতে বালুকা দিয়ে দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে চন্দনাদি গন্ধদ্রব্য, সুগন্ধি পুষ্পের মালা, বলি, ধূপ, দীপ, নানাপ্রকার উপহার দ্রব্য, পল্লব, ফল এবং তণ্ডুলাদির দ্বারা তাঁর পূজা করতেন।”
ধর্ম ভিন্ন হলেও পাঠাবলি এবং কুরবানির উদ্দেশ্য এবং প্রকৃতি প্রায় একই প্রকারের বলা চলে। দুটিই যার যার নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে সৃষ্টিকর্তার নামে সমর্পণ করে সেই পবিত্র মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা। আমি আমার এ জীবনে কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে কোনদিন দেখিনি কোরবানির বিরুদ্ধে কখনো কোন নেতিবাচক মন্তব্য করতে। সে অশিক্ষিত রিক্সাওয়ালা হোক অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কারণ বিষয়টি তাদের ধর্মগ্রন্থে রয়েছে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থের বিবিধ স্থানে পশুবলির শাস্ত্রীয় নির্দেশনা থাকার পরেও, তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কিছু পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। তাদের মধ্যে এমন একটি ভাব; যদি সে বলির বিরুদ্ধে না বলে, বলির বিরুদ্ধে না লিখে তবে সে প্রগতিশীলদের কাতারে ঠাই পাবে না। এরাই আবার পশুমাংস ভোজনের সময়ে মাংসের পাতিল খালি করে ফেলে। দেখা যায়, মাংস যে রান্না করেছে তারই ভাগ্যে জোটে না বা কিঞ্চিৎ পরিমাণ জোটে। এই দ্বৈতচরিত্রের ব্যক্তিরা ভয়ংকর। বঙ্গদেশে মনসাপূজা, দুর্গাপূজা এবং কালীপূজা আসলেই এই তথাকথিত নিজে পশুভক্ষক হয়েও, ঋতুভিত্তিক পশুপ্রেমীগণ শীতনিদ্রা ত্যাগ করে জেগে উঠেন। পেটের পাকস্থলীতে হজমের অপেক্ষায় পশুমাংস নিয়ে তারা সক্রিয়ভাবে শাস্ত্রীয় পশুবলির বিরুদ্ধে লেখালেখি, প্রচারণা শুরু করে দেন। কিছু সস্তা বালখিল্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন, সনাতন ধর্মে পশুবলি অধর্মাচরণ এবং অশাস্ত্রীয়। কিন্তু বিষয়টি তা নয়; বরং সম্পূর্ণ উল্টো। অবশ্য বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই ঋতুভিত্তিক পশুপ্রেমীগণের পর্যায়ভুক্ত নয়। তাদের উদ্দেশ্য মহত্তম। তারা তাদের সাধন জীবনে অগ্রসর হতে সর্বদা উদ্ভিজ্জ আমিষ ভোজন করেন।এতে তাদের শরীর ও মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে দৈবীপথে ঊর্ধ্বগামী হয়।পশুবলি প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমি বিশ্বাস করি আর না করি, শাস্ত্রীয় পশুবলি প্রথা কিঞ্চিৎ দৃষ্টিকটু একথা সত্য। কিন্তু পশুবলি সনাতন ধর্মে অশাস্ত্রীয় নয়। প্রায় সকল শাস্ত্রগ্রন্থেই পশুবলির নির্দেশনা রয়েছে।শাক্ত সম্প্রদায়ের বেদের পরে প্রধান গ্রন্থ শ্রীচণ্ডী। এ শ্রীচণ্ডীতে একাধিক স্থানে বলি প্রদানের কথা রয়েছে। পূজায় পশুবলি প্রদানের নির্দেশনা দেবী স্বয়ং নিজমুখেই দিয়েছেন :
বলিপ্রদানে পূজয়ামগ্নিকার্যে মহোৎসবে।
সর্বং মমৈতচ্চরিতমুচ্চার্যং শ্রাব্যমেব চ।।
জানতাজানতা বাপি বলিপূজাং তথা কৃতম্ । প্রতীচ্ছিষ্যাম্যহং প্রীত্যা বহ্নিহোমং তথা কৃতম্ ॥
(শ্রীচণ্ডী:১২.১০-১১)
“বলিদানে, দেবতার পূজায়, যজ্ঞ ও হোমাদিতে এবং মহোৎসবে আমার এই মাহাত্ম্য সম্পূর্ণরূপে পাঠ ও শ্রবণ করা কর্তব্য।
আমার মাহাত্ম্যপাঠের পর বিধিজ্ঞানপূর্বক বা অজ্ঞানপূর্বক অনুষ্ঠিত বলিদানসহকারে পূজা এবং আমার উদ্দেশে অনুষ্ঠিত হোমাদি আমি প্রীতিপূর্বক গ্রহণ করি।”
যজ্ঞাদি কর্মে পশুবধজনিত পাপ হয় না। বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে:
অশুদ্ধমিতি চেৎ, ন, শব্দাৎ ॥
(ব্রহ্মসূত্র:৩.১.২৫)
“যদি এইরূপ বলা হয় যে, যজ্ঞাদিতে পশু ইত্যাদি বলি হয় বলে উহা পাপ।কিন্তু তা নয় — কারণ এর শাস্ত্রীয় প্রমাণ রয়েছে।”
শ্রুতিতে পশুবধের বিধান আছে— এবং এই কর্মের শুধুমাত্র পুণ্য ফলই হবে বলা আছে। বেদান্তসূত্রের এ সূত্রটির মাধ্যমে পূর্বসূত্রে উপস্থাপিত যজ্ঞে পশুবলি বিরোধীদের সকল আপত্তিটির খণ্ডন করা হয়েছে। আপত্তিটি ছিল যে, জীব যজ্ঞাদিতে পশু হননাদি দুষ্কর্মে পাপে লিপ্ত হয়ে বৃক্ষগুল্মাদি জন্ম প্রাপ্ত হয়। এই আপত্তিকে খণ্ডন করে বেদান্তসূত্রকার ব্যাসদেব বলেন, যজ্ঞে পশুহননাদি দ্বারা যজ্ঞকর্তার কোন পাপ বা অশুভ কর্মফলের সৃষ্টি হয় না— কারণ এটি শাস্ত্রানুমোদিত।
মহাভারতে বিবিধ স্থানেই পশুবলির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ভীষ্মপর্বে অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদগীতায় পূর্বে যে ‘দুর্গাস্তব’ রয়েছে, সে পবিত্র স্তোত্রের মধ্যেও অর্জুন দেবীকে “সর্বদা মহিষরক্তপ্রিয়ে!” বলে সম্বোধন করেছেন। কৌরবপক্ষীয় দুর্য্যোধনের সৈন্য যুদ্ধের জন্য উপস্থিত হয়েছে দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর যুদ্ধজয়সহ কল্যাণের জন্য বললেন। হে মহাবাহু অর্জুন, তুমি পবিত্রচিত্ত হয়ে যুদ্ধের অভিমুখে থেকে শত্রুগণের পরাজয়ের জন্য ‘দুর্গাস্তব’ পাঠ কর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে অর্জুন রথ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে কৃতাঞ্জলি হয়ে দুর্গাস্তব পাঠ করেন।
মানববৎসলা দুর্গা অর্জুনের ভক্তি এবং স্তোত্রে সন্তুষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে আকাশে আবির্ভূত হলেন। দেবী দুৰ্গা বললেন— “হে দুৰ্দ্ধৰ্ষ পাণ্ডুনন্দন ! তুমি অল্পকালের মধ্যেই সকল শত্রুগণকে জয় করবে। কারণ, স্বয়ং নারায়ণ তোমার সহায় এবং তুমিও মহর্ষি নরের অবতার ; সুতরাং তুমি শত্রুগণের কেন—স্বয়ং ইন্দ্রেরও অজেয়।”
যুদ্ধজয়ের বরদান করে দেবী অন্তর্হিত হলেন। অর্জুনও দেবীকর্তৃক বর লাভ করে ধর্মযুদ্ধে জয়লাভের নিশ্চয়তা পেলেন। এরপরে অর্জুন নিজের উত্তম রথে আরোহণ করে রথের সারথি শ্রীকৃষ্ণসহ দিব্য শঙ্খধ্বনি করলেন।
দেবীপুরাণের বিভিন্ন স্থানে পশুবলির প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। দেবতারা বলি দিয়ে দেবীর পূজা করেছেন, সন্তুষ্ট করেছেন।
“বর্ষা প্রভাতে আশ্বিন মাসে অষ্টমী অর্ধরাতে দেবীকে নিষ্ঠার সাথে পূজা করে যারা মহিষ, ছাগ বলি প্রদান করেন, জগতে তাঁরা মহাবলশালী হয়ে থাকেন।”
দেবী দুর্বলদের পূজা কখনোই গ্রহণ করেন না। অনেক দুর্বলচিত্ত অহিংসার নামে নিজের নপুংসকতা এবং দুর্বলতাকে আচ্ছাদিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু দেবীর শরণে থাকলে মনুষ্যের কোন ভয় নেই। দেবী তাঁর আশ্রিত ভক্তের সর্বপ্রকার ভয় হরণ করে নেন।
“কমলাসনা দেবীমূর্তি আরোগ্য, ধর্ম, কাম, অর্থ ও মুক্তি প্রদান করেন। প্রেতাসনা দেবী পশুবলি গ্রহণ করে নিত্য সর্ববিধ ভয় হরণ করেন।”
প্রেতাসনা বলতে প্রেত বা শবের ওপর অধিষ্ঠিতা দেবী বোঝানো হয়েছে। কালী, তারা, চামুণ্ডা সবাই শবাসনা। দেবীকে পূজা করলে দেবী নিজেই চতুর্বিধ ফল দেন।শুভনিশুম্ভ বধ করেছেন যে কৃষ্ণবর্ণা হস্তে মুণ্ড এবং ত্রিশুলধারিণী কৌশিকীদেবী (কালী) বলি মাংসে অত্যন্ত তৃপ্তা হন।
“বলি, মাংস, অন্ন, নৈবদ্য এই দেবীর খুব প্রিয় । এই দেবীকে কৃষ্ণবর্ণ চন্দন , মালা দিতে হয় । তুরুস্ক , অগুরু ইত্যাদি দ্বারা হোম করলে দেবী সর্বভয় নাশ করেন । “
দেবী রক্তমালা ও রক্তবস্ত্র ধারণ করেন। বিধিভাবে পূজা করলে এই দেবী সর্ব্বসিদ্ধি প্রদান করেন ।দেবীপুরাণে কার্ত্তিক মাসের চতুর্দশী ও অমাবস্যা তিথিতে বলি দিয়ে দেবীর পূজা বিধান আছে-
“কার্ত্তিক মাসে দীপমালা দান করে পূজা করবে। ঐ মাসের চতুর্দশী এবং অমাবস্যার দিন দীপমালা, দীপচক্র ও দীপবৃক্ষাদি নির্মাণ করিবে। ঐ দিবস বলি- পূজা- হোম করা কর্তব্য। দেবতাদের অভ্যুত্থান ও মনুষ্য, অশ্ব, হস্তি প্রভৃতির নীরাজন করবে (যুদ্ধযাত্রার পূর্বে অস্ত্রশস্ত্রাদি পরিষ্কারকরণ তথা অর্চনাকরণ)। কার্তিক মাসে দেবীর পূজা এবং দেবীর উদ্দেশ্য যজ্ঞ করবে। যজ্ঞ দেবীর অত্যন্ত প্রিয়।”
দেবীপুরাণেই স্বয়ং ব্রহ্মা বলেছেন- উদর তৃপ্তির জন্য প্রানী হত্যা করে খেলে পাপ। কিন্তু যজ্ঞের উদ্দেশ্যে দেবতাকে উৎসর্গ করে, সেই উৎসর্গিত মাংস গ্রহণ করলে কোন পাপ স্পর্শ করে না।
“ব্রহ্মা বললেন, হে পুরন্দর ! যজ্ঞের জন্যই পশুর সৃষ্টি । যজ্ঞে তাদের বধ শাস্ত্রে বিহিত রয়েছে । যজ্ঞের কার্য্যে , বাক্য , মন , কায় ও কর্ম ছাড়া বাকী কর্মে পশুঘাত করলে পাপ হয়।
দেবকার্য্যে, পিতৃকার্য্যে ও মনুষ্যকৃত্যে পশুবধ করলে পাপ হয় না। এর বিপরীতে করলে বরং পাপ হয় ।
দেবতা ও পিতৃগণকে নিবেদিন না করে নূতন কৃষর, পিঠা, পায়স, মধু, ঘৃত ও দেবতাকে অনিবেদিত বৃথামাংস ভক্ষণ করবে না।”
“মৃগমাংস , ছাগ মাংস ও শসমাংস আমার অতি প্রিয় । সুতরাং এসব আমাকে নিবেদন করে দেবে। বিস্তৃত যজ্ঞে ছাগ ও অনান্য পশু দান করে বেদপারগ ব্রাহ্মণ কে সমর্পণ করলে আমি তাহার অংশভাগী হই।
আমাকে মহিষ মাংস , ক্ষীর, দৈ ও ঘি দান করতে হয়। কোনো কোনো বৈষ্ণবব্রতে মাংস দান করাও নিয়ম। হে বসুন্ধরা ! সম্প্রতি আমাকে যে সকল পাখীর মাংস আমাকে দিতে হয় তা উল্লেখ করছি, শ্রবণ করো।
লাবক, কার্ত্তিক , কাপিঞ্জল ও অনেক প্রকার মাংস আমার কাজে প্রযুক্ত । যে সব দ্রব্য আমার কাজে দান করতে হয় তা বললাম।”
ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডসহ বিবিধ স্থানে দেবী দুর্গা, দেবী মনসা, দেবী মঙ্গলচণ্ডীসহ শক্তিপূজায় অত্যাবশকীয় পূজার উপাচার হিসেবে বলি প্রদান করতে বলা হয়েছে। সেখানে ভক্তিপূর্বক নানাপ্রকার নৈবেদ্য, বস্ত্র, অলঙ্কার, মাল্য, পায়স, পিষ্টক, মধু, সুধা, নানাপ্রকার সুপক্ক ফলসহ বিবিধ উপাচারের সাথে ছাগ, মেষ, মহিষ প্রভৃতি পশুবলি দিয়ে মঙ্গলচণ্ডী দেবীর পূজা করা হয়েছে। এবং পশুবলিসহ সকল উপাচারের সাথে সংকীর্তন, বাদ্যাদির মাধ্যমে আনন্দপূর্বক কৃষ্ণনাম কীৰ্ত্তন করার কথাও বর্ণিত হয়েছে।
“ওঁ জয় ত্বং কামভূতেশে – ইত্যাদি মন্ত্রে সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী দেবীকে বলিপ্রদানপূর্বক পূজা সমাপন করবে।”
বৃহর্দ্ধমপুরাণের পূর্বখণ্ডে মহাষ্টমীতে উপবাস অবলম্বন করে এবং নবমীতে বলিদান দ্বারা মহাভক্তিসহকারে দেবীর দুর্গার পূজা করতে দেবী স্বয়ং আদেশ করেছেন। ঐ দুইদিন কোটীযোগিনীরও পূজা অবশ্য কর্তব্য। অষ্টমী নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজার গুরুত্ব অপরিসীম।
“সপ্তমিতে গৃহে এসে পূজা করবে। এরপরে দুইদিন নানাবিধ বলি, পূজা, ও জাগরণাদি দ্বারা আমার পূজা করবে। মহাষ্টমীতে উপবাস অবলম্বন করবে এবং নবমীতে বলিদান দ্বারা মহাভক্তিসহকারে আমার পূজা করবে। ঐ দুইদিন কোটীযোগিনীরও পূজা অবশ্য কর্তব্য। অষ্টমী নবমীর সন্ধিক্ষণে আমার পূজার বৎসর তুল্য কাল। এরমধ্যে আবার নবমীক্ষণ কল্পস্বরূপ কাল।অর্থাৎ অষ্টমীক্ষণে একবার পূজা করলে দেবীর বৎসরব্যাপী পূজার ফল লাভ হয়। নবমীক্ষণে পূজা করলে কল্পব্যাপী পূজার ফল লাভ হয়।”
দেবীভাগবতের নবমস্কন্ধে বলা হয়েছে, দেবী মনসাকে যে ব্যক্তি বলি প্রদান করে, সে ধনবান, কীর্তিমান এবং পুত্রবান হয়। তাই সর্বদা নিষ্ঠার সাথে বলিদান করে দেবীকে পূজা করে সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন।
“উচ্ছীর্ষক অর্থাৎ প্রসিদ্ধ দেবগৃহের শীর্ষস্থানে বা গৃহস্থের শয়নগৃহের ঊর্দ্ধভাগে উত্তর বা পূর্বদিকে লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে ‘শ্রিয়ৈ নমঃ’ মন্ত্রোচ্চারণ পূর্বক বলি প্রদান করবে এবং ভদ্রকালীর উদ্দেশ্যে ‘ভদ্রকাল্যৈ নমঃ’ মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক বলি প্রদান করবে। গৃহমধ্যে ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে ‘ব্রহ্মণে নমঃ’ ও বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে ‘বাস্তোষ্পতয়ে নমঃ’ মন্ত্রোচ্চারণ করে বলি প্রদান করবে।”
দেবী কালীর উদ্দেশ্যে পাঁঠাবলি প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, মা কালী চিরকাল ভক্তের সমর্পিত পাঠাবলি গ্রহণ করেছেন, যখন এই সৃষ্টি যতদিন থাকবে এর কোন ব্যত্যয় হবে না। তিনি এই দেশীর মূলধারার ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধিতাকারী বিধর্মীদের চিন্তা এবং সংস্কৃতির অনুসারী নব্যপন্থীদের উপরে ব্যাপকভাবে বিরক্ত ছিলেন। তাই স্বামী বিবেকানন্দ তাদের উদ্দেশ্যে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, যদি এদেশীয় পরম্পরাগত সংস্কৃতি পছন্দ না হয়, তবে সরে পড়তে। এ প্রসঙ্গে তিনি সুর চড়া করে আরও বলেন, দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন সহ্য করা কখনোই সম্ভব নয়। যাদের এদেশীয় মূলধারা সংস্কৃতি পছন্দ না হয়; তারা চড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে, তাদের জন্য সমগ্র পৃথিবী পড়ে রয়েছে। কিন্তু তা নয়, তাদের অন্যত্র যাওয়ারও মুরদ নেই আবার ; আবার এদেশে বসে এদেশের পরম্পরায়গত ধর্ম সংস্কৃতিরই দিবারাত্রি বিরোধিতা করবে।
“এদেশে সেই বুড়ো শিব বসে আছেন, মা কালী পাঁঠা খাচ্ছেন, আর বংশীধারী বাঁশী বাজাচ্ছেন। ঐ বুড়ো শিব ষাঁড় চড়ে ভারতবর্ষ থেকে একদিকে সুমাত্রা, বোর্নিও, সেলিবিস, মায়, অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার কিনারা পর্যন্ত ডমরু বাজিয়ে এককালে বেড়িয়েছেন, আর একদিকে তিব্বত, চীন, জাপান, সাইবেরিয়া পর্যন্ত বুড়ো শিব ষাঁড় চরিয়েছেন, এখনও চরাচ্ছেন; ঐ যে মা কালী – উনি চীন জাপান পর্যন্ত পূজা খাচ্ছেন, ওঁকেই যীশুর মা মেরী করে ক্রিশ্চানরা পূজা করছে। ঐ যে হিমালয় পাহাড় দেখছ, ওরই উত্তরে কৈলাশ, সেথা বুড়া শিবের প্রধান আড্ডা। ও কৈলাশ দশমুণ্ড-কুড়িহাত রাবণ নাড়াতে পারেননি, ও কি এখন পাদ্রী-ফাদ্রীর কর্ম! ঐ বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন—এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন? তোমাদের দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন হতে হবে বুঝি ? চড়ে খাওগে না কেন? এত বড় দুনিয়াটা পড়ে তো রয়েছে। তা নয়। মুরদ কোথায়? ঐ বুড়ো শিবের অন্ন খাবেন, আর নিমকহারামী করবেন, যীশুর জয় গাইবেন—আ মরি!”
(বাণী ও রচনা (ষষ্ঠ খণ্ড) ২০১৫: ১১৮- ১১৯)
জগজ্জননীরূপে যিনি সকল জীবকে সৃষ্টি করেন, সেই তিনিই জীবের অন্তিমকালে মহাকালীরূপে জীবকে গ্রাস করেন। তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই লয় করেন। এ শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, তিনি জীবকে সৃষ্টি করেছেন তিনি কি করে নিজের সৃষ্ট সন্তান বা জীবকে অন্তকালে গ্রাস করেন- তবে তা জ্ঞানহীন অজ্ঞানতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সৃষ্টি, স্থিতি, লয় বা জন্ম, জীবনধারা এবং বিনাশের অধিশ্বরী তিনি। তিনিই ব্রহ্মাণী শক্তরূপে ভগবান ব্রহ্মাকে সৃষ্টিতে শক্তি প্রদান করেন। তিনিই বৈষ্ণবী শক্তি রূপে ভগবান বিষ্ণুকে সক্রিয় করেন। এবং তিনিই মাহেশ্বরী বা কালিকা শক্তি রূপে ভগবান মহেশ্বরকে বিনাশে সামর্থ্য প্রদান করেন। এক শক্তিরই খেলা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী, দ্বৈততা বা দ্বিধা শুধু আমাদের মরজগতে। কিন্তু তিনি এক অদ্বিতীয় এবং অচিন্তনীয়।
তথ্য সহায়তা:
১. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (ষষ্ঠ খণ্ড), উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: সেপ্টেম্বর ২০১৫