বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের অনতিদূরে অবস্থিত একটি বহু প্রাচীন গ্রাম সিয়ান। পৌরাণিক যুগে এখানে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল বলে জনশ্রুতি আছে। সিয়ান গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমায় শ্বেতবসন্ত নামে এক হিন্দু রাজা রাজত্ব করতেন। মুসলমান আক্রমণের ফলে এই রাজার রাজ্যচ্যুতি ঘটে, এমন কিংবদন্তীও প্রচলিত।

১৯৭১ খ্ৰীষ্টাব্দের শেষদিকে, সিয়ান গ্রামের শাহজাহানপুর পাড়ার মখদুম শাহ জালানের জীর্ণ একটি দরগায় দুটি শিলাফলক পাওয়া যায়। দেখা যায়, তাতে একাদশ শতাব্দীর গৌড়ীয় লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। ফলক দুটি আসলে একটি বৃহৎ ফলকের দুই ভগ্ন অংশ। দুটি ফলকই ক্ষত-বিক্ষত, জীর্ণ, অস্পষ্ট। বহু পরিশ্রমে, বহু অধ্যবসায়ে শ্রী দীনেশচন্দ্র সরকার মহাশয় বিভিন্ন অংশের কিছু কিছু পাঠোদ্ধার করেছেন।
দীনেশচন্দ্র বলছেন, সিয়ান গ্রামের এই প্রশস্তিটি আসলে পালরাজা নয়পালের (আ. ১০২৭-১০৪৩ খ্ৰীষ্টাব্দ) বিভিন্ন ধর্মকর্ম সংক্রান্ত কীর্তির কার্যবিবরণী। লিপিতে বর্ণিত নয়পালের কীর্তির মধ্যে কয়েকটি হল:
১. পুরারি বা শিবের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা ও শৈব সাধুদের বাসের জন্য একটি দ্বিতল মঠ নির্মাণ।
২. একাদশ রুদ্রমূর্তি প্রতিষ্ঠা।
৩. জগন্মাতার জন্য স্বৰ্ণকলস শোভিত মন্দিরের চূড়া নির্মাণ।
৪. পাথরের তৈরী মন্দিরে নয়টি চণ্ডিকামূর্তি প্রতিষ্ঠা।
৫. দেবীকোটে হেতুকেশ শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা।
৬. ক্ষেমেশ্বর শিবের পাথরের মন্দির, মঠ ও সরোবর প্রতিষ্ঠা।
৭. উচ্চদেব-সংজ্ঞক বিষ্ণুমন্দির, তৎসংলগ্ন আরোগ্যশালা ও বৈদ্যাবাস প্রতিষ্ঠা।
৮. ঘন্টী বা শিব ও তার চারিদিকে চৌষট্টি মাতৃকামূর্তি প্রতিষ্ঠা।
৯. চম্পা নগরীতে বটেশ্বরের শিলামন্দির প্রতিষ্ঠা।
১০. মহেন্দ্ৰপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চর্চিকা বা জগদম্বার শৈলমন্দিরে প্রস্তর চূড়া ও সোপান নির্মাণ।
১১. ধর্মারণ্যে মাতঙ্গব্যাপীর সংস্কার।
১২. মাতঙ্গেশ্বর শিবের মন্দির নির্মাণ এবং সেই মন্দিরে শিবের কন্যা শ্ৰী বা লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা।
১৩. সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠা।
১৪. বৈদ্যনাথ শিবের স্বর্ণখোল নির্মাণ এবং মন্দির শিখরে স্বর্ণকলস স্থাপন।
১৫. অট্টহাসে জগন্মাতার মন্দিরে স্বৰ্ণকলস স্থাপন।
১৬. গঙ্গাসাগরে স্বর্ণত্রিশূল, রৌপ্যের সদাশিব প্রতিমা, স্বর্ণের চণ্ডিকা ও গণেশ প্রতিমা এবং এই প্রতিমা দুটির স্বৰ্ণপীঠ নির্মাণ।
১৭. চন্দ্র প্রতিমা, রৌপ্যের সূর্য প্রতিমা, শিবের স্বর্ণপ্রতিমা এবং নবগ্রহের জন্য স্বর্ণপদ্ম নির্মাণ।
১৮. শৈবসাধুদের জন্য মঠ প্রতিষ্ঠা, একটি মঠ নির্মাণ ও তন্মধ্যে বৈকুণ্ঠ বিষ্ণু প্রতিমা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: Temples with Atanu.
এ-প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্ৰ বলছেন, “পালবংশীয় রাজা নয়পালকে পূর্বে বৌদ্ধ মনে করা হইত। বাণগড় শিলা-প্রশস্তির আবিষ্কারের ফলে দেখা গিয়াছে যে, তিনি শৈব্যাচার্য সর্বশিবের নিকট শিবমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। সুতরাং তিনি শিব এবং শক্তির উপাসক ছিলেন বলা যায়; কিন্তু পৌরাণিক বা স্মার্ত মতাবলম্বী হিন্দুর ন্যায় অন্যান্য দেবদেবীকেও তিনি অবজ্ঞা করিতেন না। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, সিয়ান-প্রশস্তিতে রাজার কীর্তিকলাপের মধ্যে বৌদ্ধবিহার নির্মাণ এবং বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠার কোন স্পষ্ট উল্লেখ নাই।”
ফলকটির পিছনদিকে আরবী অক্ষরেও একটি লিপি উৎকীর্ণ আছে। আরবী লিপিটিতে লেখা আছে, হিজরী সনের ৬১৮ বর্ষে (১২২১ খ্রীঃ) দ্বিতীয় জুমাদা মাসে, বুরহানের পৌত্র ও ইবাদের পুত্র আলি শেরের সময়ে, ফকির ও সুফিদের সুবিধার জন্য একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান একটি খানকা (ধর্মীয় জমায়েত স্থান) প্রতিষ্ঠা করলেন।
সিয়ান গ্রামের এই শিলালিপির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। অসম্পূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত শিলালিপিটির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার ও ব্যাখ্যা উভয়ই অত্যন্ত কঠিন কাজ, কিন্তু অমূল্য লিপিটি যেভাবে অবহেলায় পড়ে রয়েছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গদেশের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবে তা অনায়াসেই বোঝা যায়।
তথ্যসূত্র:
বীরভূম জেলার পুরাকীর্তি – অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
শিলালেখ-তাম্রশাসনাদির প্রসঙ্গ – ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকার
সিয়ান গ্রামের শিলালেখ – সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩৮৩ বর্ষ।
লেখা: Temples with Atanu.