বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো যেন ধ্বংসস্তূপের আড়ালে অতীত লুকিয়ে রেখেছে
ভারতের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তার পৌত্র অশোকের বিশাল অধ্যায়ের মধ্যে তার পুত্র বিন্দুসারের রাজত্বকাল যেমন দু-পাতায় সমাপ্ত হয়ে যায়। তেমনই বিজয় সেন ও তার পৌত্র লক্ষণ সেনের সমৃদ্ধ অধ্যায়ের মধ্যে কীর্তিমান বল্লাল সেনের কীর্তি দু-পাতায় মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
বল্লাল সেনের ঢিবি, বামুনপুকুর, নদীয়া
স্ব-রচিত অসমাপ্ত গ্রন্থ “অদ্ভুতসাগরে” বর্ণিত ‘গৌড় রাজ দমনকারি’ বল্লাল সেনের রাজত্বকাল লেখ্য প্রমাণ ও ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি থেকে মনে করা হয় যে তার রাজত্ব ও শান্তিপূর্ণ কাজের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল।
ঐতিহ্যবাহী নদীয়ার নবদ্বীপ এবং মায়াপুর ধাম থেকে কিছু দূরে চাঁদকাজীর সামাধির উত্তর-পশ্চিম দিকে বামুনপুকুরে অবস্থিত এই পুরাকীর্তি বর্তমানে সুবিশাল ভগ্নস্তুপ। বহু প্রাচীনকাল থেকেই জনমুখে প্রচলিত নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয় বল্লাল সেনের ঢিবি। কলকাতা কেন্দ্রিক ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে এই বিশাল ইটের কমপ্লেক্সটির খনন সমাপ্ত করে। এই বিশাল স্থাপত্যের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমশিলা মহাবিহার ও বিহারের সোমপুর মহাবিহারের মিল রয়েছে। অষ্টম এবং নবম শতাব্দীতে পাল-সেন দুই সময়ে নির্মিত এই স্তূপ সম্ভবত ১১ শতক পর্যন্ত শিক্ষা ও তীর্থস্থান হিসেবে টিকে ছিল। প্রথম দিকে ১০ থেকে ১২ শতকের মধ্যে নির্মিত একটি বৌদ্ধস্তূপ মনে করা হলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে ১১ থেকে ১৩ শতকের মধ্যে নির্মিত একটি সুবিশাল মন্দির কমপ্লেক্স বলে মনে করা হয়।
খনন কার্যের আগে এই জায়গাটিকে ইতিহাসবিদরা সেন রাজাদের রাজধানী হিসেবে মনে করতেন। আবার কেউ কেউ এটিকে সামন্ত সেনের আমলে নির্মিত স্থাপনা বলে মনে করতেন। কোন তথ্য প্রমাণ না থাকলেও বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেনের নাম অনুসারে বিজয় নগর বা বিজয়পুর হিসেবে এক আধুনিক শহরের অবশিষ্ট ধ্বংসস্তূপ বলে মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং সেই অত্যাধুনিক শহরের সন্ধানও এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রায় দুই দফায় এই বৃহৎ খনন কার্যটি সম্পন্ন করা হয়। প্রথম দফায় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ এবং দ্বিতীয় দফা ১৯৮৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। প্রথমদিকে এই ইমারতটির গঠন স্থাপত্য দেখে ঐতিহাসিকরা এটিকে বৌদ্ধস্তূপ, মন্দির এবং প্রাসাদ এর মধ্যে ঠিক কোনটি তা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৩ হাজার স্কয়ার ফুটের ইট, চুন সুড়কি দ্বারা নির্মিত বিশাল স্ট্রাকচারাল ইমারত, ২৫ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দেওয়াল, ও চারিদিকে উচ্চ প্রাচীর দ্বারা আবৃত এই পুরাকীর্তিকে দেবালয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আবার পঞ্চাননকৃত ‘গোষ্ঠীকথা’ তেও বলা হয়েছে যে, বল্লাল সেনের জাননগরের উত্তরে প্রাসাদে বাস করার কথা। নদীয়ার ঠাকুরনগরের আরেক স্থাপত্যের সাথে এর যোগসূত্র আছে।
বল্লাল সেনের “অদ্ভুতসাগরে” গ্রন্থে ও বাংলাদেশের গোদাগড়ির দেবপাড়া লেখাতে এই মন্দির কমপ্লেক্সের কথা বিদ্যমান। মনে করা হয় এই মন্দির কমপ্লেক্সের পাশ দিয়ে ভাগীরথীর প্রবাহ বিদ্যমান ছিল, বর্তমানে তা অনেকাংশ কিছুটা দূরে সরে গেছে। অষ্টম ও নবম শতকে ধ্বংসপ্রাপ্ত বা অসমাপ্ত এই স্থাপত্য কীর্তিটিকে বিভিন্ন সময় মেরামত এবং পুনঃনির্মিত করা হয়েছে। দ্বাদশ শতকে সেই পুরাতন কাঠামোর উপর নতুন করে এই মন্দির কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হয় যা সুপষ্টভাবে একটি দেবালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে উপগ্রহ চিত্র থেকে এই মন্দিরকে ডবল ক্রস প্যাটার্নের মন্দির হিসাবে সুপষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। আবার এখানে কিছু যজ্ঞের উপাদানও পাওয়া গিয়েছিল এবং তার সাথে পূজার বিভিন্ন উপকরণ। মন্দিরের স্থাপত্যকীর্তির সাথে অনেকটা শ্রী যন্ত্রের মিল পাওয়া যায়। বর্তমানে এটিকের শিব মন্দির হিসেবে অনেক ইতিহাসবিদ মান্যতা দিয়েছেন। বহু প্রাচীন তথ্যে এই স্থান গঙ্গার তীরে বল্লাল সেনের পূর্ণ আশ্রম হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। যে স্থানে প্রায় দুই দশক রাজত্বের পর বল্লাল সেনের সপত্নীক বানপ্রস্থ আশ্রমের পালন এবং গঙ্গার জলে আত্ম বিসর্জনের কথা পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে ASI (Archaeological Survey of India) এই জায়গাটিকে অধিগ্রহণের আগে স্থানীয় অধিবাসীরা বহু ইট চুরি করেছেন, এবং তার সাথে হয়তো বহু শিলা লেখ অজান্তে তারা নষ্ট করে ফেলেছেন। হয়তো এসব প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান চুরি না হলে আমরা ইতিহাসের আরো অজানা তথ্য খুঁজে বার করতে পারতাম।
ASI এর খননকার কার্যের ফলে এর ভেতর থেকে পঙ্খের মূর্তি, পোড়া মাটির মানুষ, বিভিন্ন জীবজন্তুর মূর্তি, তামা ও লোহার তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র, পেরেক ও নানা প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী। বর্তমানে এর বেশিরভাগই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এবং কলকাতা জাদুঘরেও তার কিছুটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। সমগ্র কমপ্লেক্সে শুধুমাত্র একটি ধাতু নির্মিত কুমিরাকৃতির মুখ বিদ্যমান। যেটি মূলত মন্দিরের জলধারা প্রবাহের কাজে ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া বিশেষ ধাতু নির্মিত এরকম বড় এবং ভারী কোন দ্রব্য বা ভাস্কর্য পাওয়া যায়নি।
এই পুরাকীর্তির ধ্বংসের তথ্য সম্পূর্ণ না জানা গেলেও মনে করা হয় সেন রাজত্বের শেষে বহিরাগত আক্রমণের দ্বারা বা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ও এই বিশাল স্থাপত্যটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। উৎখননের পর এই বিশাল খনন কার্যটি অনাবৃত অবস্থায় সবুজ ঘাস দ্বারা আবৃত হয়ে আছে। বর্তমানে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর দেখাশোনার দায়িত্বভার পালন করছে। তারা এই স্থানটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে- ঢিবি এবং একটি দুর্গের অবশিষ্ট অংশ। তা বর্তমানে কাঁটাতারের সুরক্ষার মধ্যে বিনাশুল্কে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা রয়েছে।
চিত্র সংগ্রহ ও লেখা: M Rahul Mondal তথ্যসূত্র: নদীয়ার পুরাকীর্তি – মোহিত রায় নবদ্বীপ মহিমা – কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী ভারত ইতিহাসের সন্ধানে – দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়