নরবলি নয়, "মৃত্যুদণ্ড" - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • October 1, 2023
  • Last Update September 30, 2023 10:21 pm
  • kolkata

সনাতন ধর্মে পশুবলি একটি সুপ্রাচীন বৈদিক প্রথা। বেদ পরবর্তী রামায়ণ, মহাভারত, বিবিধ পুরাণসহ অধিকাংশ শাস্ত্রেই পশুবলির কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পশুবলি প্রসঙ্গ আসলেই পশুবলি বিরোধী পক্ষ পশুবলিকে অযৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য কালিকাপুরাণের বিভিন্ন শ্লোককে দৃষ্টান্ত হিসাবে নিয়ে আসেন। যে শ্লোকগুলোতে বর্ণিত হয়েছে নরবলির কথা। এই নরবলিকে দেখিয়ে তারা শাস্ত্রীয় পশুবলি প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা করে। কিন্তু আমরা যদি খুব ভালো করে কালিকাপুরাণের ৬৭ তম অধ্যায়টি পাঠ করি, তবে দেখতে পাব কালিকাপুরাণে কোথায় নরবলির কথা নেই, আছে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের কথা বা যুদ্ধে পরাজিত শত্রুপক্ষের নেতৃত্বকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার কথা। যেহেতু রাজা বা রাজার নির্দেশনায় মন্ত্রীগণ শুধু দণ্ড প্রধান করতে পারে, তাই কালিকা পুরাণে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে; নরবলি বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান একমাত্র দিতে পারেন রাজা। রাজার অনুমতিতে রাজপুত্র, অমাত্য, সচিব অর্থাৎ রাজার মন্ত্রী পরিষদ পারবে। সৌপ্তিকগণ গুটিকয়েক রাজপুরুষ ছাড়া সকলের দৃষ্টিসীমার আড়ালে গভীর রাত্রে রাজার নামে নরবলি বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। তবে রাজার অনুমতি ছাড়া নরবলি প্রদান করা হলে, যারা করবে তারা ভয়ংকর পাপে নিমজ্জিত হয়ে নরকগামী হবে। কিন্তু দেশে কোনো প্রকারের উপদ্রব উপস্থিত হলে অথবা যুদ্ধকালে রাজসম্পর্কীয় পুরুষগণ দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, শান্তি ও স্থিতাবস্থার প্রয়োজনে দোষি ব্যক্তিদেরকে বলি বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারবে। তবে একথা বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, রাজার অনুমতিক্রমে রাজপুত্র, অমাত্য, সচিব ও সৌপ্তিকগণ ছাড়া অন্য কেউ কখনো নরবলি বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারবে না।

রাজপুত্রস্তথামাত্যঃ সচিবঃ সৌপ্তিকাদয়ঃ।
দদ্যুর্নরবলিং ভূপ সম্পত্ত্যা বিভবায় চ ॥
নৃপাননুমতে মৰ্ত্তং দত্ত্বা পাপমবাপ্নুয়াৎ ।
উপপ্লুবে রণে বাপি যথেচ্ছং বিতরেন্নরঃ ॥
যঃ কশ্চিদ্রাজপুরুষো নান্যত্ত্বপি কদাচন ।
(কালিকাপুরাণ: ৬৭.১২২-১২৪)

“রাজপুত্র, অমাত্য, সচিব ও সৌপ্তিকগণ রাজার সম্পত্তি ও বিভবের নিমিত্ত নরবলি প্রদান করবে।তারা রাজার অনুমতি ছাড়া নরবলি প্রদান করলে ভয়ংকর পাপে নিমজ্জিত হবে। তবে কোনো প্রকারের উপদ্রব উপস্থিত হলে অথবা যুদ্ধকালে যে কোনো রাজসম্পর্কীয় পুরুষ ইচ্ছানুসারে মনুষ্য বলি প্রদান করতে পারবে। রাজার অনুমতিক্রমে রাজপুত্র, অমাত্য, সচিব ও সৌপ্তিকগণ ছাড়া অন্য কেউ নরবলি প্রদান করতে পারবে না।”

রাজা ছাড়া যেমন কেউ নরবলি বা কাউকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারে না, এ বিষয়টি কালিকাপুরাণে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি তন্ত্রেও বলা হয়েছে। শ্যামারহস্যে উদ্ধৃত যামলবচনে বলা হয়েছে, কেবল রাজাই নরবলি দিতে পারেন, এ ব্যতিরেক অন্য কেউ নয়।
“রাজা নরবলিং দদ্যাৎ নান্যোঽপি পরমেশ্বরী।”

বর্তমানে অধিকাংশ দেশেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ফাঁসির মাধ্যমে। কিন্তু প্রাচীনকালে ভারতবর্ষসহ অধিকাংশ দেশেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো ঘাড় থেকে গলাকে বিচ্ছিন্ন করা বা শূলে চড়িয়ে।গলাকে বিচ্ছিন্ন করা বা শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পূর্বে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে স্নান করিয়ে বেশকিছু ধর্মীয় কৃত্যাদি করতে হতো। যে প্রথা বর্তমানকালে ফাঁসির আসামির ক্ষেত্রেও শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীব্যাপী আজও দেখা যায়। শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, অপরাধী ব্যক্তিকে রাজা দণ্ড প্রদান করেন, সেই দণ্ড পরবর্তীতে সে পাপ থেকে মুক্ত হয়। সেই পাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়ার জন্যে দেবতার সম্মুখে তাকে বলি নামক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। পূর্বেই বলা হয়েছে, রাজা ছাড়া কেউ নরবলি বা মৃত্যুদণ্ড প্রাদান করতে পারবে না। তাই অপরাধীর বলি বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর পরবর্তীতে রাজাই নিজহাতে মাটির বা তৈজসপাত্রে বলির রক্ত উৎসর্গ করবে। পুরোহিত বা অন্য কেউ নয়।

রুধিরাণি প্রদদ্যাত্তু ভূতিকামো নরোত্তমঃ ।
নরস্য তু সদা রক্তং মাহেয়ে তৈসজেঽথ বা । দদ্যাদন্নরপতিস্তস্তু ন পত্রাদৌ কদাচন ॥
(কালিকাপুরাণ: ৬৭.৪৭)

“রাজা সর্বদা মনুষ্যের রক্ত মাটিরপাত্রে বা তৈজসপাত্রে রেখে, তবে উৎসর্গ করবে, পাতায় নির্মিত দোনাদিতে কখনই উৎসর্গ করবে না ৷”

একমাত্র রাজা যেহেতু রাজদণ্ড প্রদান করতে পারে, তাই রাজা ছাড়া ব্রাহ্মণ-শূদ্রাদি কোনো জাতিই নরবলি বা মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারেন না। ব্রাহ্মণ সিংহ, বাঘ ও নরবলি প্রদান করলে সে ভয়ংকর নরকে গমন করে। ইহলোকে সে হীন আয়ু হয়ে, ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে দ্রুত মৃত্যুবরণ করেন এবং তার জীবনে সুখ ও সৌভাগ্য বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।

সিংহং ব্যাঘ্রং নরঞ্চাপি স্বগাত্ররুধিরং তথা ।
ন দদ্যাদ্ ব্রাহ্মণো মদ্যং মহাদেব্যৈ কদাচন ৷৷
সিংহং ব্যাঘ্রন্নরং দত্ত্বা ব্রাহ্মণো নরকং ব্রজেৎ।
ইহাপি স্যাৎ স হীনায়ুঃ সুখসৌভাগ্যবর্জ্জিতঃ।। স্বগাত্ররুধিরং দদ্যাচ্চাত্মবধ্যামবাপ্নুয়াৎ।
মদ্যং দত্ত্বা ব্রাহ্মণস্তু ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে ৷৷
(কালিকাপুরাণ: ৬৭.৫০-৫২)

“ব্রাহ্মণ, দেবীর নিকট সিংহ, ব্যাঘ্র, মনুষ্য, স্বকীয় গাত্রের রুধির অথবা মদ্য কখনই বলি প্রদান করবে না।
ব্রাহ্মণ সিংহ, ব্যাঘ্র এবং নরবলি প্রদান করলে সে নরকে গমন করে এবং ইহলোকে হীন আয়ু ও সুখ-সৌভাগ্যহীন হয় ।
ব্রাহ্মণ স্বীয় গাত্রের রুধির দান করে আত্মহত্যার পাপ প্রাপ্ত হয় এবং মদ্য প্রদান করলে ব্রাহ্মণ্য হতে চ্যুত হয়।”

রাজা ব্রাহ্মণ বা শূদ্রকে কখনো বলি প্রদান করবে না এবং রাজপুত্রকেও বলিদান করবে না। তবে শত্রু রাজার পুত্র যদি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হয়, তবে দেশরক্ষার প্রয়োজনে তাকে বলি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে।

ন ব্রাহ্মণং বলিং দদ্যাচ্চাণ্ডালমপি পার্থিব ।
নোৎসৃষ্টং দ্বিজদেবেভ্যো ভূপতেস্তনয়ং তথা।
রণেন বিজিতং দদ্যাত্তনয়ং রিপুভূভৃতঃ।।
(কালিকাপুরাণ: ৬৭. ১০৬-১০৭)

“রাজা, দেব-দ্বিজগণের উদ্দেশে অর্চিত ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্রকে বলি প্রদান করবে না এবং রাজপুত্রকেও বলিদান করবে না। তবে শত্রু ভূপতির পুত্র যদি যুদ্ধে পরাজিত হয়, তবে দেশরক্ষার প্রয়োজনে তাকে বলি দিতে পারে।”

রাজা যদি স্বেচ্ছাচারী হয়ে নিরপরাধ কাউকে বলি প্রদান করে, তবে রাজা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। বলি পরবর্তীতে নরবলির ছিন্ন-মস্তক যে যে বাক্য উচ্চারণ করে, তা অচিরেই সফল হয়। অন্যায়ভাবে যদি কাউকে বলির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়, তবে সেই অন্যায়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভে যদি বলিকৃত ব্যক্তি মৃত্যুকালে হুঙ্কার প্রদান করে, তবে সেই বলির আদেশ প্রদানকারী রাজার রাজ্য সমূলে বিনষ্ট হয়।

হসতি চ্ছিন্নশীর্ষঞ্চেস্নারং স্যাত্তু রিপুক্ষয়ঃ। শ্রীবৃদ্ধিরায়ুষো বৃদ্ধিঃ সদা দাতুরসংশয়ঃ ॥
যদ্‌যদ্বাক্যং নিগদতি তথা ভবতি চাচিরাৎ । হূঙ্কারাদ্রাজ্যহানিঃ স্যাৎ শ্লেষ্মস্রাবাচ্চ পঞ্চতা ॥
(কালিকাপুরাণ: ৬৭. ১৪১-১৪২)

“যদি নরবলির ছিন্ন শির হাস্য করে, তবে শত্রুর বিনাশ হয় এবং বলিদাতার সর্বদা লক্ষ্মী ও পরমায়ু বৃদ্ধি হয়, সে বিষয়ে কোন সংশয় নেই।
নরবলির ছিন্ন-মস্তক যে যে বাক্য উচ্চারণ করে, তা অচিরেই সফল হয়। সে মৃত্যুকালে হুঙ্কার করলে রাজ্যের হানি হয় এবং শ্লেষ্মস্রাব করলে কর্তার মৃত্যু হয়।”

কৃতজ্ঞতা: শ্রী কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। 

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *