বঙ্গ-কলিঙ্গ সীমান্তের এক অখ্যাত বৌদ্ধ মহাবিহারের ইতিকথা - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • May 23, 2023
  • Last Update April 29, 2023 5:58 pm
  • kolkata

পথের সঞ্চয়।

আজ থেকে প্রায় ৫০ পুরুষ আগেকার কথা। বঙ্গ-কলিঙ্গ সীমান্তের এক অখ্যাত জনপদ। ভগবান তথাগতের পবিত্র দন্তের উপর নির্মিত হল এক বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ বিহারগুলিকে আগে ‘বন’ বলে চিহ্নিত করা হত। জায়গার নাম হল “দন্তবন”।
তবে কেউ বলেন এর নাম ছিল দণ্ডভুক্তি। ওড়িয়া ভাষায় ‘দাণ্ড’ মানে পথ। ‘দাণ্ড’ শব্দটি বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হয় ‘দণ্ড’ নামে। আর প্রাচীন ভারতে ‘ভুক্তি’ কথার অর্থ হল প্রদেশ। অর্থাৎ সেই সময় উৎকলে যাওয়ার একমাত্র পথ হওয়ায় এই প্রদেশের নাম হয় দণ্ডভুক্তি। গৌড়রাজ শশাঙ্কের লিপি থেকে জানা গিয়েছে, দণ্ডভুক্তি আঞ্চলিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।

কালের পথ ধরে দন্তবন বা দণ্ডভুক্তি হল দাঁতন।
খড়্গপুর থেকে যে লাইনটা সোজা কটক, ভূবনেশ্বর হয়ে দক্ষিণ ভারতে চলে গেছে, তারই এক ছোট্ট স্টেশন দাঁতন। স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে কিলোমিটার খানেক গেলে সুবিস্তৃত জাতীয় সড়ক। সেই ধরে উত্তর মুখো ৩/৪ কিলোমিটার গেলেই মনোহরপুর পঞ্চায়েতের মোগলমারী গ্রাম।

জাতীয় সড়ক থেকে সুবর্ণরেখার দিকে মিনিট খানেক হেঁটে গেলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে ১৪০০ বছরের প্রাচীন এক বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ। যার পোশাকি নাম “মোগলমারী বৌদ্ধ বিহার”। যদি আশা করে থাকেন সেখানে সাজানো আছে প্রত্নতত্ত্বসামগ্রী থরে থরে, তাহলে হতাশ হবেন। অযত্নের ছাপ সর্বত্র। আগাছা, অগোছালো ভাব যত না পীড়া দেয়, তার থেকে বেশী কষ্ট পাবেন যখন দেখবেন ১৪০০ বছর আগেকার বৌদ্ধ বিহারের উপর সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে “মোগলমারী তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগার”! কোনো সভ্য দেশে এমনটা হয় বলে জানি না।
যাই হোক, গেট পার করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবেন। বাম দিকে বিহারের ধ্বংসাবশেষের ধ্বংসাবশেষ। আগাছা ঢেকে দিচ্ছে অমূল্য সম্পদকে। উপরে উঠে একটু এগিয়ে গেলে মূল আকর্ষণ – বিহারের একটি দেওয়াল। নানা মূর্তি খোদিত। পুরোটা পাকাপোক্ত ভাবে ঢাকা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক অশোক দত্তের নেতৃত্বে একদল পুরাতাত্ত্বিক ২০০৩ সালে মোগলমারিতে প্রথম খননকার্য শুরু করেন। ২০০৩-০৪ সালে খননকার্যের প্রথম পর্যায় মোগলমারি গ্রামের দুটি জায়গাকে খননের জন্য বেছে নেওয়া হয়। প্রথম জায়গাটির নাম দেওয়া হয়েছিল এমজিএম১। ইঁটের এই ঢিপিটি স্থানীয়ভাবে “সখিসেনের ঢিপি” বা “শশীসেনের ঢিপি” নামে পরিচিত ছিল।এমজিএম২ নামাঙ্কিত দ্বিতীয় জায়গাটি স্থানীয় বসত এলাকায় অবস্থিত। এটি পাঁচটি গোলাকার ইঁটের স্তুপের উপর অবস্থিত। প্রথম জায়গাটি “ত্রিরথ” আকারের। এই জায়গাটির পশ্চিমাংশে উত্তর-দক্ষিণে পাঁচিল সহ একটি জায়গা পাওয়া গিয়েছে। এটিকে সন্ন্যাসীদের প্রাচীর বেষ্টিত একটি ছোটো বাসস্থান মনে করা হচ্ছে। খননকার্যের ফলে অন্যান্য প্রাচীন জিনিসের সঙ্গে বর্গাকার ও আয়তাকার নির্মাণের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এগুলিকে ছোটো ছোটো ঘর মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয় জায়গাটিতে যে তিনটি গোলাকার ইঁটের নির্মাণ পাওয়া গিয়েছে, এগুলিকে স্তুপের ভিত্তি মনে করা হচ্ছে। এই ধ্বংসাবশেষটি সম্ভবত ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর। আরও খননকার্যের ফলে ৫৫ সেন্টিমিটার কাদার স্তর এবং তার নিচে কালো ও লাল রঙের কিছু সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে।

এমজিএম১-এ ২০০৬-০৭ সালে আরও গভীর খননকার্য শুরু হয়। এমজিএম৩ নামে খননকার্যের জন্য আরও একটি জায়গা এই সময়েই বেছে নেওয়া হয়। এই খননকার্যের ফলে ফুল, পশু ও মানুষের ছবি আঁকা একটি দীর্ঘ দেওয়াল পাওয়া যায়। এখানেও নির্মাণের সাতটি স্তর লক্ষ্য করা হয়। এই খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী হল শ্লেট পাথরে নির্মিত একটি বুদ্ধমূর্তি।
২০১২ সালে আরেক রাউন্ড খননকার্যের দলে দেওয়ালগুলিতে বুদ্ধকেন্দ্রিক নানারকম ছবি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বোধিসত্ত্বদের ছবি এবং বৌদ্ধ শিলালেখ পাওয়া যায়। এই খননকার্যের ফলে জায়গাটির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে প্রদক্ষিণ পথও আবিষ্কৃত হয়। আর পাওয়া যায় একটি কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এই মন্দিরে অনেকগুলি বর্গাকার উঠোন-বিশিষ্ঠ খোপ ছিল। খননকারী দলের সদস্য রজত সান্যালের মতে, নির্মাণটি বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান পর্বে নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই পর্যায়েই বৌদ্ধধর্মে দেবদেবীর পূজা শুরু হয়। মোগলমারিতে খননকার্য চালিয়ে যে দেওয়ালগুলি পাওয়া গিয়েছে সেখানে জামবালা ও সরস্বতী দেবীর ছবি দেখেই এই অনুমান করা হয়েছে। এখানে প্রাপ্ত মূর্তি ও অন্যান্য সামগ্রীগুলিতে গুপ্ত ও মধ্য গঙ্গ অঞ্চলের ভাস্কর্যের প্রভাব দেখা যায়।

২০০৩ সালে প্রথম দাঁতন এক নম্বর ব্লকে সুবর্ণরেখা নদীর পূর্বে অবস্থিত এই মোগলমারিতে খননকার্যটি শুরু হয়৷ প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বৌদ্ধবিহারটি আবিষ্কৃত হয়৷ তারপর থেকে দফায় দফায় খননকার্যে এই বৌদ্ধবিহার থেকে ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা টেরাকোটার একটি লিপি থেকে শুরু করে বেশ কিছু মূর্তি পাওয়া যায়।

সাম্প্রতি গবেষকেরা মোগলমারী বুদ্ধ বিহারের প্রাচীননাম “বান্দান” হিসেবে উল্লেখকরেছেন। শব্দটিবর্তমান বন্দর শব্দের সমগোত্রীয়। অর্থাৎ এই অঞ্চলটি জলপথে যোগাযোগের একটি অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল তা এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির গঠন দেখলে অনুমান করা যায়। কাঁসাই, কপিশা বাকংসবতী নদী যে একসময় এই অঞ্চলেই সমুদ্রেরসাথে মিলিত হয়েছিল এখানকার ভূমির আন্তর্গঠনই সেই সাক্ষ্য বহন করে।বর্তমানে কাঁসাই নদী কেশপুরের কাছে দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গেছে। একটি শাখা দাশপুর অঞ্চলের উপর দিয়ে পালারপাই নামে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদের দিকে এগিয়ে গেছে ও অপর শাখাটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কালিয়াঘাই বা কেলেঘাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
বিহারের বৈশিষ্ট
বিহারটি চতুস্কোনাকৃতি (৬০/৬০ মিটার)। চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
– প্রাচীরের বাইরে একটি পরিখা। পরিখাটি জলনিকাশি ব্যবস্থার সাথে যুক্ত।
– দেয়ালগুলিতে সুচিত্রিত নানা মূর্তি।
– পাওয়া গেছে ভগবান বুদ্ধের একটি প্রস্তর মূর্তি।
– এছাড়া পাওয়া গেছে নানা রঙের মাটির বাসন, মাটির প্রদীপ এবং পিলসুজ।

– বিহারটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ৪০ প্রকার বিভিন্ন আকারের ইট।
– একটি জাঁতাকল, হামানদিস্তার মোটা পাথর।
– লাল রঙের একটি মাটির পাত্রের মধ্যে অনেক লোহার পেরেক।
– কাঠ কয়লার স্তুপ।
– কতকগুলি কড়ি।
– পাওয়া গেছে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা মাটির তৈরি শিলমোহর।
– প্রাচীরের বাইরের দেয়ালে পাওয়া গেছে বুদ্ধের উপবেশন মুদ্রায় নানা মূর্তি, যক্ষিণী-মূর্তি, রমণী মূর্তি যার হাতে আছে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল।

পথনির্দেশ: কলকাতা থেকে সহজতম পথে শালিমার স্টেশন থেকে ৯.১৫ তে (অথবা সাঁতরাগাছি সুবিধা মনে হলে ওখান থেকে) ধৌলি এক্সপ্রেস ধরে পৌনে বারোটায় দাঁতন পৌঁছে যান সরাসরি। ওড়িশার দিকে মুখ করে ডান হাতে স্টেশন থেকে বানর হয়ে হেঁটে বা টোটোতে জাতীয় সড়ক। বেলদা গামী বাসে উঠে মিনিট ৭/৮ গেলেই মহাবিহার নামব বললে নামিয়ে দেবে কন্ডাক্টর।
দিনের শেষে ঘর পানে চলুন ইতিহাসের একটা পৃষ্ঠা নিয়ে।

লেখা : Supriya Banerjee.

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *