গুর্জর-প্রতিহাররা কী ভারতীয় কুলোদ্ভব ছিল? - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • June 7, 2023
  • Last Update April 29, 2023 5:58 pm
  • kolkata

গুর্জর প্রতিহার রাজবংশ 

অধিকাংশ ইতিহাসবিদ আজকাল গুর্জর-প্রতিহারদের ভারতীয় কুলোদ্ভব বলেই মনে করেন। এদের মধ্যে চিন্তামণি বৈদ্য, গৌরিশঙ্কর হীরাচাঁদ, রমেশচন্দ্র মজুমদার উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, দশরথ শর্মা, ক.ম. মুন্সী, কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার, বৈজনাথ পুরী, ব.শ. পাঠক নতুন নতুন তথ্য জুড়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন — গুর্জর-প্রতিহাররা ভারতীয় ছিল, বিদেশী নয়। এদের মতভেদ কেবল গুর্জর শব্দের শিকড় নিয়ে – তা ‘কূলবোধক’ নাকি ‘জাতি বোধক’? যারা গুর্জর-প্রতিহারদের বিদেশী কুলোদ্ভব মনে করেন, তাদের চোখে গুর্জর শব্দটা কূলের শাসক অর্থে বোঝায়; কিন্তু যারা গুর্জর-প্রতিহারদের স্বদেশী মনে করে তাদের চোখে তা জাতিবোধক। অর্থাৎ গুর্জরদেশের রাজ অর্থে গুর্জর-প্রতিহার শব্দটা বোঝায়, এই হল তাদের অভিমত।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, দুটো সম্ভাবনাই থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তিনি দাবি করেছেন গুর্জরদেশ নামে কোনও রাজ্যের উল্লেখ অতীতের কোনও নথিপত্রে মেলে নি। তার মতে, সম্ভবত ব্যক্তিগত অর্থে গুর্জর শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে।

চিন্তামণি বৈদ্য তার ‘মিডিয়াভ্যাল হিন্দু ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে দাবি করেছেন গুর্জররা কোনও ভাবেই বিদেশী নয়। তাদের শারীরিক গঠন, গাত্রবর্ণ ও তাদের দ্বারা ব্যবহৃত ভাষার ঢং দেখে বৈদ্য দাবি করেন এরা সম্পূর্ণ ভাবে ভারতীয় ও আর্য কুলোদ্ভব। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন গুর্জররা বিদেশী যেমন নয়, তেমনই সম্পূর্ণ ভারতীয়ও নয়। তাঁর মতে, এরা বর্ণসংকর জাতির লোক ছিল — পিতা হয়ত বিদেশী, কিন্তু মাতা ভারতীয়। কালক্রমে এরা ধীরে ধীরে ভারতীয় চেহারা পায়। রমেশচন্দ্র মজুমদার এও দাবি করেছেন প্রাচীন ভারতবর্ষে যেসব বিদেশীদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হত, তাদের সাধারণত বৈশ্য বা শূদ্র বর্ণের অন্তর্গত করা হত, খুব কম ক্ষেত্রে ক্ষত্রিয় হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতেন। অথচ এদিকে দেখা যাচ্ছে কিছু অভিলেখে গুর্জর-প্রতিহাররা নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবি করেছেন। যা থেকে এদের বিদেশী বলে ভাবা অসম্ভব। সম্ভবত এরা কান্যকুব্জ, সারস্বত বা মৈথিলী ব্রাহ্মণদের মতই গুর্জর ব্রাহ্মণ ছিলেন।

গুর্জর শব্দ প্রথম যিনি ব্যবহার করেন তার নাম হিউয়েন সাং। পরে বাণভট্টও তার গ্রন্থে গুর্জরদের উল্লেখ করেছেন। মুন্সী মহাশয় তার গ্রন্থে স্থানবাচক রাজবংশের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে হিউয়েনৎসাং কিউ-ইয়ে-লো (গুর্জর) রাজ্যের রাজধানী হিসাবে পি-লো-মো-লো বা ভিনমাল এর উল্লেখ করেছেন। গুর্জর-প্রতিহার শাসক মহেন্দ্রপালের নিজস্ব মহাসামন্ত দ্বিতীয় অবন্তীবর্মণ তার ঊণা অভিলেখে উল্লেখ করেছেন যে, তার পিতা বলবর্মণ নাকি জজ্জপের রাজাকে হত্যা করে পৃথিবী থেকে হূণবংশকে বিলুপ্ত করে দিয়েছেন! এথেকে স্পষ্ট হয় যে, গুর্জররা যদি খাজারদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বংশধর হত, তবে নিশ্চয়ই তার মহাসামন্তের ‘হূণদের বিলুপ্ত করেছি’ মার্কা কথা লেখার সাহস হত না। হূণরা ভারতীয় সমাজের অঙ্গীভূত হয়েছে এরকম পাথুরে প্রমাণ একাদশ শতকের পূর্বে কোনও অভিলেখে মেলে নি। যদি গুর্জররা হূণই হত, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত দ্রুত তারা হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত হল কীভাবে? কিভাবেই বা তারা শূদ্র না হয়ে উচ্চবর্ণ পদাধিকারী হবার সৌভাগ্য অর্জন করল? পৃথ্বীরাজরাসৌ গ্রন্থে যে চাহমান, পারমার, চালুক্য ও প্রতিহাররা নাকি আবু পর্বতে যজ্ঞকুণ্ড থেকে উৎপন্ন হয়েছিল, তার কোনও পুঁথিগত প্রমাণ কোনও ভারতীয় বা বিদেশী গ্রন্থে মেলে নি। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে চন্দবরদাই কেবল মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা ‘মিথ’ রচনা করেছেন, যার কোনও বাস্তব সত্যতা নেই। শুধু তাই নয়, অগ্নিদ্বারা পরিশোধনের মাধ্যমে বিদেশীদের হিন্দু ধর্মে নিয়ে আসার রেওয়াজ দশম শতকের আগে ছিল না। অথচ এদিকে আদি গুর্জর রাজাদের যেসব শিলালিপি বা মুদ্রা পাওয়া গেছে তা অষ্টম ও নবম শতকের।

তাই ধরে নেওয়া যায়, তারা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ছিল। আর চন্দবরদাই যে অগ্নিকুণ্ড থেকে উৎপন্ন হবার দাবি করেছেন, তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে, উপরোক্ত চার রাজবংশ শুরুতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। পরবর্তীকালে তারা পতিত হন এবং ক্ষত্রিয় হিসাবে গণ্য হতে থাকেন। এই সম্ভাবনাই সর্বাধিক হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, আদি গুর্জর শিলালিপিতেও ব্রাহ্মণ হবার দাবি আছে। আগেই বলেছি যে সংস্কৃত ‘প্রতিহার্তৃ’ শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণ উপদেষ্টা, যা থেকেই প্রতিহার এসেছে বলে অনেকেই মনে করেন।

পর্ব: ৩

প্রথম পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন।

দ্বিতীয় পর্বের জন্য এখানে ক্লিক করুন। 

তথ্যসূত্রঃ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশুদ্ধানন্দ পাঠক।

লেখা: অয়ন চক্রবর্তী।

 

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *