অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেন, পরাধীন ভারতে যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • May 30, 2023
  • Last Update April 29, 2023 5:58 pm
  • kolkata

“… আমি পিছু পিছু চললাম, কিছুদূর এগিয়ে একটা মন্দিরের কাছে দু’জনেই পৌছলাম। দরজা খােলাই ছিল। মাষ্টারদা আর আমি ভেতরে ঢুকলাম। তারপর তিনি টর্চ জ্বালালেন। দেখলাম, ভীষণাননা এক কালী মূর্তি। মাষ্টারদা একহাত লম্বা একখানা ডেগার বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, মায়ের সামনে বুকের রক্ত দিয়ে পূজো কর। ওখানে বেল পাতা আছে। আমি বুকের মাঝখানের চামড়া খানিকটা টেনে ধরে একটুখানি কাটার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোটা রক্ত বের হল। তা বেল পাতায় করে মাষ্টার দার কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বেশ স্পষ্ট করে বললেন, … মায়ের চরণে দিয়ে বল জীবনে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। আমি অসংকোচে মায়ের চরণে রক্ত আর মাথা রেখে এ প্রতিজ্ঞা করলাম। …”

১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘কারা স্মৃতি’ গ্রন্থে মাস্টারদার বৈপ্লবিক ছাত্রী কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা বর্ণনা করেছিলেন কিভাবে দীক্ষা নিতে হতো তাঁদের।


আইন অমান্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল বাংলায়। ঢাকা, বরিশাল, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে চরমপন্থী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। হিন্দু বিপ্লবীরা কুমিল্লার ইংরেজ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে হত্যা করে। চট্টগ্রামে সূর্যসেনের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অস্ত্রাগার অধিকার করা হয়। এই কর্মকান্ডে সূর্যসেন তার গোটা বাহিনীকেই ব্যবহার করেন। শুধু অস্ত্রাগার অধিকারই নয়, চট্টগ্রামে তাঁরা ব্রিটিশ কর্তৃত্বকেও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার যে প্রস্তাব গ্রহণ করে, চট্টগ্রামে তারই বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিল সূর্যসেনরা। স্বরাজ কবে দ্বারে সমাগত হবে তার জন্য অপেক্ষা না করে স্বরাজ হাতে তুলে নেওয়ার জন্যই অস্ত্রাগার অধিকার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সূর্যসেন। এসব আমরা সবাই প্রায় কমবেশি জানি।…


১৯২৬ সালে মতিলাল নেহেরু তাঁর পুত্র জওহরলালকে লেখেন, “বাংলার বিপ্লবীরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে গভীরভাবে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন।” কমরেড মুজাফফর আহমেদও লিখেছিলেন, “বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা হিন্দু উত্থানেরও আন্দোলন ছিল। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।”

 

সূর্য সেন ছিলেন কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী নেতাদের প্রিয়পাত্র। ১৯২৮ সালের যে কলকাতা কংগ্রেস সম্মেলনে ‘নেহেরু রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয় এবং লীগ ও কংগ্রেসের বিচ্ছেদে সীলমোহর পড়ে, সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। চট্টগ্রাম থেকে কংগ্রেসের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।

পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁর ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’ বইতে লিখছেন,
“১৯২৮-এর কংগ্রেস সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে যারা বিপ্লবীদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার মধ্যে ছিলেন―সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহ ইত্যাদি”

শুধু তাই নয়, ১৯২৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের যে লাহাের সম্মেলনে মুsলিম লীগ ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে এককভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা ও আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, সে সম্মেলনেও সূর্যসেন চট্টগ্রাম থেকে কংগ্রেসের প্রতিনিধি ছিলেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মতে

“চট্টগ্রাম থেকে লাহাের কংগ্রেসেও প্রতিনিধি হিসেবে যান সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী। তখন জেলা কংগ্রেস সূর্যসেন দলের হাতে, তাই প্রতিনিধি দলেও তাদের পছন্দমত লােক তারা নিয়েছেন।”

পরবর্তীকালে কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদী নেতা এবং হিন্দু মহাসভার দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা মহামনা মদনমোহন মালব্যের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠে। মালব্যের ইচ্ছানুসারে যে নিখিল ভারত ছাত্র কনভেনশন ডাকা হয় সেই সভাতেও মাস্টারদার অনুগামীরা অংশগ্রহণ করেন।


আসলে সূর্যসেন ছিলেন ‘মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত’ এক ‘সন্তান’। বঙ্কিমের আনন্দমঠ এবং হিন্দু জাগরণের ট্র্যাডিশন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক সেনানায়ক।

‘দৈনিক ইনকিলাব’ সংবাদপত্রে ১৯৯৪ সালের ২৩শে মার্চ ‛সন্ত্রাসবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও ষড়যন্ত্রের শতবর্ষপূর্তি’ প্রবন্ধে খন্দকার হাসনাত করিম লিখেছেন:-

“…এই বিপ্লবী তৎপরতার পুরোটাই ছিল লালা লাজপত, বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিন পাল প্রদর্শিত হিন্দু পুনর্জাগরণবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। চট্টগ্রামের এই বিপ্লবীদের মন্ত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‛বন্দেমাতরম’।…বিপ্লবীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো― ‛বাহুতে মা তুমি শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে/ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরনধারিনীম্’ ইত্যাদি।”

জেলখানায় সূর্যসেনের একমাত্র পাঠ্য গ্রন্থ ছিল ‘রামায়ন। জেলখানায়ও তিনি বন্দেমাতরম শ্লোগান দিতেন। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সূর্যসেনের ফাঁসি কার্যকরী হয়। ফাঁসিতে মৃত্যুবরণের আগে তার শেষ উচ্চারণ ছিল ‘বন্দেমাতরম। ‘আমাদের মুক্তিসংগ্রাম’ পুস্তকে মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছেন:–

“সরকার কর্তৃক সূর্য সেন ও তারেকেশ্বরের ফাঁসির দিন গােপন রাখা সত্ত্বেও বন্দী বিপ্লবীরা কোন এক সূত্রে জানিতে পারে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাহাদের উভয়ের ফাসি হইবে। এ সংবাদ সূর্য সেনকে জানানাে হইলে তিনি অন্যান্য বন্দীদিগকে বলিয়া পাঠান, ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর তিনি তাহাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলিবেন। তদনুযায়ী সন্ধ্যার পর তিনি তাহার প্রকোষ্ঠের দ্বারের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া প্রথমে উচ্চস্বরে বন্দেমাতরম ধ্বনি করেন। সূর্য সেনের কণ্ঠস্বর শ্রবণ মাত্রই জেলের শত শত বন্দী সমস্বরে বন্দেমাতরম ধ্বনি করিয়া উঠে। কয়েক মিনিট পর্যন্ত কেবল শ্লোগানই চলে। … প্রত্যুষে ফাঁসির সময় আবার সকলে গােলমাল করিতে পারে আশঙ্কা করিয়া সশস্ত্র সৈন্যরা প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রমে সূর্য সেন ও তারেকেশ্বরের প্রকোষ্ঠের দরজা খুলিয়া ভেতরে প্রবেশ করে যাহাতে তাহারা কোন শ্লোগান দিতে বা বক্তৃতা দিতে না পারে।”

তথ্যসূত্র:
১) ‛নেহেরু’; মাইকেল এডওয়ার্ডস
২) ‛স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’; পূর্ণেন্দু দস্তিদার
৩) ‛আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’; মুজাফফর আহমেদ
৪) ‘আমাদের মুক্তিসংগ্রাম’; মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ
৫) দৈনিক ইনকিলাব সংগ্রহ
৬) ‛বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’; এম এ মতিন
৭) ‛কারা স্মৃতি’ ; কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা

লেখা: আমাগো একখান দ্যাশ আসিলো

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *