১৬ই আগস্ট ১৯৪৬ - দ্যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং - The Bengal Tribune
The Bengal Tribune
  • September 27, 2023
  • Last Update September 26, 2023 5:56 pm
  • kolkata

ক্যাবিনেট মিশনের ভারত-ত্যাগের পর ১৯৪৬ সালের ৬-৭ ই জুলাই বোম্বাইয়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভা বসে এবং সেখানে মন্ত্রী মিশন পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। এই অধিবেশনেই নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১০ ই জুলাই সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে নেহরু বলেনঃ “কংগ্রেস গণপরিষদে অংশগ্রহণ করবে স্বাধীনভাবে,কোনরকম বাধ্যবাধকতা নিয়ে নয়।” অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ কংগ্রেস উক্ত পরিষদে যোগ দেবে এটাই শুধু স্বীকার করেছে।সুতরাং প্রয়োজনবোধে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার হেরফের করার স্বাধীনতা তার রয়েছে।” নেহরু এই বিবৃতি দিয়ে মারাত্মক ভুল করেন।জিন্না ক্ষুব্ধ হন এই ঘটনায়।২৯ শে জুলাই মুসলিম লীগ মন্ত্রী মিশন থেকে তাদের পূর্ব-অনুমোদন প্রত্যাহার করে নেয়, অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদানে অসম্মতি জানায়,’পাকিস্তান’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হয়।

জিন্না লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে আদেশ দেন ‘প্রত্যক্ষ’ সংগ্রামের (ডাইরেক্ট একশন)।এ প্রসঙ্গে হাডসন লিখেছেন,” শুধু ক্যাবিনেট মিশন নয়,প্রত্যক্ষ সংগ্রামের অর্থ ছিল অমুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং রাজনৈতিক -সামাজিক অঙ্গন সহিংসতার রক্তে ভাসিয়ে দেয়া।জিন্নার মতো বুদ্ধিমান রাজনীতিকের না জানার কথা নয় এ ধরনের জিহাদ ঘোষণার ফল কী হতে পারে।তিনি জানতেন এবং জেনেশুনেই তার ক্রোধ মিটাতে নিরপরাধ মানুষের রক্ত নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন রক্তের বিনিময়ে জিঘাংসার তরবারিতে দেশবিভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে।”

২৯ শে জুলাই লীগের সভায় সমাপ্তি ভাষণে জিন্না জানিয়েছিলেন যে,”আজকের সভায় আমরা যা করলাম তা আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বীরোচিত কাজ।এতদিন আমরা সাংবাদিক পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কোন পন্থা গ্রহণ করিনি।কিন্তু এখন আমরা সংবিধান ও সাংবিধানিক পদ্ধতিকে বিদায় জানাচ্ছি।” শুধু তাই নয় হাডসন লিখেছেন, ‘ জিন্না বলেন এতদিন আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ ধরে চলেছি,এখন হাতে পিস্তল তুলে নেয়া ও তা ব্যবহারের সময় এসে গেছে।’ জিন্না ১৪ ই আগস্ট এক বিবৃতি মারফৎ মুসলিম সমাজকে ১৬ ই আগস্ট ‘ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালনের আহবান জানান।

৩০ শে জুলাই থেকেই লীগের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল।বাংলার লীগ সভাপতি নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন,আর দেরি নয়,সময় এসে গেছে।কলকাতায় গঠন করা হল মুশলিম ন্যাশনাল গার্ড। প্রতিটি জেলায় খোলা হয় প্রশিক্ষণ শিবির।বাংলার লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী মুসলমান যুব সমাজকে সর্বশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হবার আহবান জানানঃ Marshall all your forces under the banner of the Muslim League।লীগের হুশিয়ারী ছিল ‘ কংগ্রেসকে দিয়ে হিন্দু সরকার গঠন করানো হলেই মুসলমানদের সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে।’

কলিকাতার মেয়র মহম্মদ উসমান উর্দুতে একটা প্রচারপত্র বিলি করেন,যাতে লেখা ছিল,’ আশা ছেড়ো না,তরোয়াল তুলে নাও,ওহে কাফের তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়।’ প্রচার পত্রটিতে ছাপা হয়েছিল তরবারি হাতে জিন্নার ছবি।এইরকম প্রচুর প্রচারপত্র গোপনে বিলি করা হয়েছিল,যাতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি ছিল-

১) ভারতবর্ষের সকল মুসলমান পাকিস্তানের দাবীতে প্রাণ দেবে।

২) পাকিস্তান স্থাপিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভারতবর্ষের বুকে মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হবে।

৩) ভারতের সমস্ত বসবাসকারীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হবে।

৪) হিন্দু মালিকানাধীন সমস্ত কারখানা ও দোকানগুলি পুড়িয়ে দিতে হবে,ধ্বংস করতে হবে,লুঠ করতে হবে এবং লুঠ করা সামগ্রী লিগের অফিসে জমা দিতে হবে।

৫)সমস্ত মন্দির ধ্বংস করতে হবে।ইত্যাদি।

৬)ভারতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে,আমাদের সকলের হাতে তীক্ষ্ণ তরবারি থাকবে,আমরা ১৬ ই আগস্ট তারিখে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করবো যাতে কেউ ঘুমোতে পারবে না।

৭)১০ কোটি ভারতীয় মুসলমান দুর্ভাগ্যবশত হিন্দু এবং ব্রিটিশদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে,তারা এই রমজাম মাসেই জেহাদ আরম্ভ করবে।ইত্যাদি।

স্বভাবতই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিচালিত হল হিন্দুদের বিরুদ্ধে।১৬ ই আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৬ ই আগস্ট লীগের পক্ষ থেকে স্থির করা হয়েছিল তারা মিটিং মিছিল করবেন এবং ময়দানে সমাবেশ করবেন।কিন্তু ইহা শীঘ্রই বদলে গিয়েছিল মারদাঙ্গায়।

১৬ ই আগস্ট ভোর থেকেই একতরফা হিন্দুদের উপর আক্রমণ নেমে এসেছিল।ভোর ৪ টে ৩০ এ প্রথম একজন ব্যক্তি ছুরিকাহত হন।সকাল ৬ টা থেকেই সশস্ত্র মানুষ রাস্তায় জমায়েত হতে থাকে। মানিকতলা মোড়ে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ভাঙচুর করা হয়।মসজিদের ভিতর লীগ ক্যাডাররা লুকিয়ে ছিল,তারা রাস্তায় নেমে আসে।বিবেকানন্দ রোডের উপর থাকা শীতলা মন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয়।টালা ব্রিজ,বাগবাজার,শোভাবাজার,মেটিয়াবুরুজ,মোমিনপুর,বড়বাজার, শিয়ালদহ, রিপন স্ট্রীট, মল্লিকবাজার,চিৎপুর,টেরিটি বাজার,চিত্তরঞ্জন এভেনিউ,হ্যারিসন রোড,সেন্ট্রাল এভেনিউ,জ্যাকেরিয়া স্ট্রীট,মেছুয়াবাজার স্ট্রীট,ধর্মতলা, কলেজ স্ট্রীট রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়।খুন, নারী ধর্ষণ,দোকান লুটপাট,বাড়ি আক্রমণ ১৬ ই আগস্ট কলকাতাকে নরকে পরিণত করেছিল। চারিদিকে শুধু হাহাকার আর রক্ত স্রোত।

পঞ্চানন ঘোষাল তাঁর পুলিশ কাহিনী (খণ্ড ২) গ্রন্থে লিখেছেন,” লীগ ছুটি ঘোষণা করায় মুসিলিমরা গড়ের মাঠে বিরাট সভার আয়োজন করল।হিন্দুরা আতংকগ্রস্ত হলেও সাংঘাতিক কিছু ঘটার আশংকা করেনি,সেজন্য কোনও রকম প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন বোধ করেনি।আমরা গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী হওয়ায় আমাদেরও ছুটি।রসা রোডের বার-বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একটি মুসলিম প্রসেশন ঝাণ্ডা উঁচিয়ে মাঠের দিকে চলেছে আর ক্ষুদ্র এক উৎসুক হিন্দু জনতা তার পিছন- পিছন।মিছিল থেকে ধ্বনি উঠলো ‘ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’অনুসরণকারী হিন্দু-বালকেরা উত্তর দিচ্ছিলঃ ‘নেহী দেঙ্গে পাকিস্তান।নেহী দেঙ্গে পাকিস্তান।’লীগ নেতারা সভাস্থলে উত্তেজনামূলক বক্তৃতা দিতে থাকেন।”

নাজিমুদ্দিন,নুরুদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্ব জনসভায় কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাক দিলেন।আবুল হাশিম নিজ আত্মজীবনীতে লিখেছেন,বাংলার লীগ সভাপতি নাজিমুদ্দিন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেণ,আমাদের লড়াই কংগ্রেস আর হিন্দুদের বিরুদ্ধে।হাশিম নাজিমুদ্দিনকে ঠেলা দিয়ে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেন।কিন্তু ততক্ষণে অন্যান্য অঞ্চল থেকে দাঙ্গার খবর আসতে শুরু করেছে।আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছেন,’ সভায় প্রচার চালানো হয় বেহালা,কালীঘাট, মেটিয়াবুরুজ,মানিকতলা অঞ্চলে হিন্দুরা অনেক মুসলমানকে খুনজখম করেছে।এরপর কয়েকজন আহত মুসলমানকে কাঁধে করে নিয়ে এসে দেখানো হয় এবং সেই দৃশ্য জনতাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।’

বেছে বেছে হিন্দু বস্তি,হিন্দু পথচারী,হিন্দু বাড়িগুলিকে টার্গেট করা হয়।রাস্তার ধারে,খালে,পুকুরে মৃতদেহের স্তুপ জমে যায়।সোহরাওয়ার্দী লালবাজার কন্ট্রোল রুম থেকে সবকিছুই প্রত্যক্ষ করছিলেন।এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে জানান-” আমি কি করতে পারি?স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বসে একটির পর একটি চিরকুঠ পাঠিয়ে পুরো ব্যাপারটার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারী করেছেন।’কলকাতার মেয়র ওসমান এবং মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর তরফে পেট্রোলের বিশেষ কূপন বিলি করা হয়েছিল।এই কূপন দেওয়া হয়েছিল লীগের গুণ্ডাদের হাতে।এই কূপন বিলি করা হয়েছিল যাতে কম দামে বহিরাগত গুণ্ডারা পেট্রোল কিনতে পারে।

পঞ্চানন ঘোষাল তাঁর পুলিশ কাহিনী (খণ্ড ২) গ্রন্থে লিখেছেন,’ চারিদিকে শুধু আগুন আর হাহাকার।নারী আর নারীদের করুণ আর্তনাদ….কলিকাতা নিধন- যজ্ঞে যে বর্বরতা দিল্লিতে নাদিরশাহী হত্যা-কাণ্ডকেও লজ্জা দেয়।সুপরিকল্পিতভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রাখা হল…শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ফজলুল হক সাহেব ব্যতীত অন্য কোনও লীগ বা কংগ্রেসী নেতাকে আমরা রাজপথে দেখিনি…”

আবুল কালাম আজাদ তাঁর ” India Wins Freedom” গ্রন্থে লিখেছেন,” আমি জনসাধারণের মধ্যে এ অনুভূতি লক্ষ্য করলাম যে ১৬ ই আগস্ট মুসলিম লীগ কংগ্রেসীদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং তাদের ধনসম্পত্তি লুন্ঠন করবে।বাংলা সরকার ১৬ ই আগস্টকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠলো এবং জনসাধারণ বেশ কিছুটা ভীত হয়ে পড়লো…বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার থাকার জন্য এবং লীগের অন্যতম নেতা মিঃ এইচ.সোহরাওয়ার্দী সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলেই জনগণের মধ্যে এই ভীতির ভাবটা আরো বেশী প্রকটিত হয়…জওহরলাল ১৭ ই আগস্ট পার্লামেন্টারী কমিটির একটি সভা আহবান করেন।উক্ত সভায় অংশগ্রহণের জন্য আমি ১৬ ই আগস্ট বিমানযোগে কলকাতা থেকে দিল্লী অভিমুখে রওনা হই…১৬ ই আগস্ট দিনটি ভারতের ইতিহাসে এক মসীলিপ্ত দিন।ওই দিন কলকাতা শহরে যেরকম পাইকারী নরহত্যা ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটে তার কোন পূর্ব-নজীর নেই..ওই দিন মুসলিম লীগ যে মিছিল বের করে সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারী লোকেরা লুঠ এবং অগ্নিসংযোগ করতে করতে এগুতে থাকে…শহরের রাস্তাগুলো তখন খা খা করছে এবং সারা শহরটি যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে বলে বোধ হয়…..১৬ ই আগস্ট দিনটি যে শুধু কলকাতার জন্যই ‘কালো দিবস’, তাই নয়,সারা ভারতেই ও- দিনটি ‘ কালো দিবস।’

১৯৪৬,১৬ ই আগস্টের স্মৃতিচারণায় গোপাল গোস্বামী লিখেছেন,১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট দিনটি বাংলার ইতিহাসে যেমন স্মরণীয় একটি দিন ঠিক তেমনই আমার জীবনেও এই দিনটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা তথা জাতীয় জীবনেও এই দিনটি উল্লেখযোগ্য হওয়ার কারণ হল,এ দিনই মহম্মদ আলি জিন্না দিল্লি, বোম্বাই ইত্যাদি শহরে পাকিস্তান দাবির স্বপক্ষে Direct action কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।

অন্য শহরগুলো শান্ত থাকলেও কলকাতা কিন্তু সে দিন দাঙ্গার আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গিয়েছিল।প্রাণ গিয়েছিল প্রায় চারশোর ওপর নিরীহ নিরাপরাধ মানুষের।সেই সময় আমার ছিল ফুটবল খেলার শখ।আমি শুধু মোহনবাগান ক্লাবের মেম্বারই ছিলাম না,মোহনবাগান দলের হয়ে পাওয়ার লিগ টিমেও খেলতাম।১৬ আগস্ট মোহনবাগান মাঠে খেলা ছিল।সে দিন কলকাতায় প্রবল বর্ষণও হয়েছিল।খেলা ছিল ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে জর্জ টেলিগ্রাফের। তখন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল একই মাঠে খেলত।মোহনবাগানের প্রতীক ছিল কাঁঠাল গাছ আর ইস্টবেঙ্গলের বট গাছ।১৫ আগস্ট রাতে অফিস থেকে ফিরে বাবা আমাদের সব ভাইবোনদের সতর্ক করে বললেন-‘কালকে তোমরা কেউই বাড়ির বাইরে বেরোবে না,গণ্ডগোল হবে।’ আমরা থাকতাম তখন ডালহৌসির টেলিগ্রাফ অফিসের কোয়ার্টারে।আমি সন্ধেবেলাতেই কোয়ার্টারে ফিরে এসেছিলাম।রাতে বাবার এই কথা শুনে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।কী এমন হতে পারে তা ভেবে কুলকিনারা পেলাম না।

১৫ আগস্টের রাত কেটে ভোর হল।আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আশুতোষ চৌধুরী সকাল ৮ টা নাগাদ আমাদের কোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হল।সে থাকত বঙ্গবাসী স্কুলের উল্টোদিকে সার্পেন্টাইন লেনে।আমার কাছে এসে চুপি চুপি বলল- জানো,আজ একটা খুব মজার ব্যাপার ঘটতে চলেছে।সকাল থেকেই দেখছি রাস্তায় গাড়ি কম।ডালহৌসি স্কোয়ারের সামনে ইউরোপিয়ান ক্লাবের কাছে যথেষ্ট লুটপাট হচ্ছে। দুষ্কৃতিরা লুট হওয়া দোকানগুলো থেকে পাখাগুলো খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই ইউরোপিয়ান ক্লাবের এক দিকে এখন রাজভবন আর অন্য দিকে টেলিফোন ভবন।শুধু তাই নয়,একদল লোক জোর করে সব দোকানপত্তর বন্ধ করে দিচ্ছে।

সুরাবর্দি ছিলেন তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তার নির্দেশে পুলিশ রাস্তায় নামেনি।তখনও পর্যন্ত অবশ্য অন্যান্য ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানির কোনও সংবাদ ছিল না।আমরা কোয়ার্টারের ছাদে উঠে দেখলাম চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি।বাবা কাউকে বেরোতে দিলেন না।তিনি ছিলেন টেলিগ্রাফ অফিসের চিফ সুপারিনটেনডেন্ট। তার আদেশেই টেলিগ্রাফ অফিসের গেট বন্ধ করে দেওয়া হল,যাতে বাইরের গুণ্ডারা ভেতরে চলে আসতে না পারে।কাছাকাছি ফিয়ার্স লেন মুসলমান- প্রধান এলাকা।সেখান থেকে ট্রাম বাস লক্ষ করে অ্যাসিড বাল্ব ছোড়া হচ্ছিল।ওই পথ দিয়েই বাজারের রাস্তা বলে আমাদের খাওয়াদাওয়া তখন বন্ধ।

এক দিকে আল্লাহো আকবর চিৎকার অন্য দিকে বন্দেমাতরম ধ্বনি।আমরা ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।দেখলাম কলাবাগানের বস্তি জ্বলছে।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক হিন্দু এলাকাতেও আগুনের লেলিহান শিখা।অন্যান্য খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় অবশেষে বাবা সামনের গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে পুলিশ প্রহরায় আমাদের জন্যে কিছু খাবার আনার ব্যবস্থা করলেন। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে হিন্দু দেখলেই মুসলিম গুণ্ডারা নির্বিচারে হত্যা শুরু করেছে।

১৬ আগস্ট ছিল শুক্রবার।কিন্তু ১৭ আগস্ট শনিবার অবস্থা কিছুটা পাল্টাতে শুরু করল।হিন্দুরা অ্যালার্ট হয়ে গেল।হিন্দু এবং পাঞ্জাবিরা মিলে হাওড়া ব্রিজ বন্ধ করে দিল,যাতে বাইরে থেকে দুষ্কৃতিরা শহরে ঢুকতে না পারে। এর পর শুরু হল মুসলমানদের উপর হিন্দুদের প্রত্যাঘ্যাত। এতে আনুমানিক প্রায় চারশো মুসলমান মারা পড়েছিল।এর আগে অবশ্য মুসলমান দুষ্কৃতিদের আক্রমণে এই হাওড়াতেই হিন্দুদের লাশের পাহাড় জমে গিয়েছিল।কোয়ার্টারের প্রহরীরা বেশির ভাগই হিন্দু হওয়ায় মুসলমান দুষ্কৃতিদের খোঁজে হাতে ডাণ্ডা নিয়ে তাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল।কিন্তু দুঃখের বিষয় হিন্দুদের হাতে সে দিন অনেক নিরীহ মুসলমানের প্রাণ গিয়েছিল।

এত দিন সুরাবর্দীর পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়।তারা রাজপথে নামল রবিবার, ১৮ আগস্ট। পুলিশ এসে সরাসরি মুসলিমদের পক্ষ নিল।হিন্দুদের উপর এলোপাথাড়ি গুলি চালানোর খবরে আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।লুঠতরাজ নিয়ে তা হলে একটা কথা বলি।প্রথম দিকে এই দুষ্কৃর্ম মুসলমানরা করলেও পরে কিন্তু হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এতে জড়িয়ে পড়েছিল।এই দাঙ্গায় মেয়েদের উপর অত্যাচারও কম হয়নি।শোনা গেল নাখোদা মসজিদ প্রান্তরে হিন্দু মেয়েদের উপর অত্যাচার চলছে। এই খবরে আমরা বিমর্ষ হয়ে গেলাম।প্রায় বেশ কয়েকদিন ধরে এই দাঙ্গা চলেছিল। এই দাঙ্গার ফলে চৌরঙ্গী থেকে রাসবিহারী পর্যন্ত এলাকা রক্তগঙ্গায় ভেসে গিয়েছিল।সে আজ ইতিহাস! জীবনের সায়াহ্নে এসে সে দিনের কথা স্মরণ করে শিহরণ জাগে আর মনে হয় এমন ঘটনা কোনও দিন যেন পৃথিবীর কোনও প্রান্তে না ঘটে।

১৬ ই আগস্ট যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তার সমাপ্তি ঘটে ১৯ আগস্ট।হাডসনের হিসেবে ‘ তিন দিনের সহিংসতায় হতাহতের সংখ্যা বিশ হাজারের মতো।’ আহমদ রফিক তার ‘ দেশবিভাগঃফিরে দেখা ‘ গ্রন্থে লিখেছেন,” শুরুটা মুসলমান পক্ষে হলেও শিখ ও হিন্দুদের প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান নিধন সংখ্যায় বেশি।মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভেবে দেখেননি যে কলকাতা হিন্দুপ্রধান শহর,নানাদিক বিচারে রয়েছে ওদের ।আবারো বলি,হিসেবে ভুল ছিল তার।প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নেশায় ভুল করেছিলেন তিনি।কলকাতার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নেতা হওয়ার কারণে ভুল।”

“স্টেটসম্যান” পত্রিকা ১৬ ই আগস্ট দিনটিকে “The great calcutta killing ” আখ্যা দিয়েছিল। কিম ক্রিস্টেন ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এ লিখলেন, “আমি যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতাল দেখেছি,কাজেই বীভৎসতার চেহারা আমি চিনি।কিন্তু যুদ্ধের এই রকম চেহারা কখনও দেখিনি।” ডিসগ্রেস অ্যাবাউন্ডিং’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল,”…এই দাঙ্গা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লিগের রাজনৈতিক পেশিপ্রদর্শন…কলকাতাকে যে ভাবে রক্তাক্ত করে ফেলা হল,তা,এক প্রবল লজ্জা।বাংলার সরকার মুখ্যত মুসলিম লিগের সরকার। এই সরকারের অর্জন করা লজ্জায় আজ সারা দেশেই মুসলিম লিগের সম্মান মাটিতে মিশে গিয়েছে।”

…..সন্দীপ মুখোপাধ্যায়।

তথ্যসূত্রঃ

দেশবিভাগ: ফিরে দেখা- আহমদ রফিক।

জিন্না ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা- যশোবন্ত সিনহা।

পুলিশ কাহিনী(খণ্ড ২)- পঞ্চানন ঘোষাল।

India wins Freedom -আবুল কালাম আজাদ।

কলকাতা ও নোয়াখালী দাঙ্গা -অর্জুন গোস্বামী।

১৯৪৬ কলকাতা হত্যা এবং নোয়াখালি গণহত্যা – দীনেশ চন্দ্র সিনহা,অশোক দাশগুপ্ত ও আশিস
চৌধুরী।

ইতিহাসের দিকে ফিরে: ছেচল্লিশের দাঙ্গা – সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *